অলিউল্লা নোমান: দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক জনপ্রিয় লেখক জনাব মাহমুদুর রহমানকে ৩ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ টাকা। পুরো রায়টি প্রকাশিত হয়নি। কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ সোস্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যারা সেদিন এই অন্ধকার আদালতে উপস্থিত ছিলেন তারা গণমাধ্যমে রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ গুলো প্রকাশ করেছেন।
এতে জানা গেছে মাহমুদুর রহমানকে কোন দুর্নীতির জন্য দন্ড দেয়া হয়নি। দুর্নীতির জন্য দন্ড দিবেইবা কেমন করে! মাহমুদুর রহমান কারাগারে যাওয়ার আগে বহুবার চ্যালেঞ্জ করেছেন। এক পয়সার অবৈধ সম্পাদ থাকলে বের করার চ্যালেঞ্জ তিনি ছুড়ে দিয়েছেন বহুবার। ২০০৯ সালে নিজেই সরাসরি শেখ হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ করে লিখেছিলেন-‘সততায় পারবেন না প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে কলাম। সততায় প্রশ্নে মাহমুদুর রহমানের কাছে পরাজিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতির জন্য দন্ড দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত তদন্তে মাহমুদুর রহমানের দুর্নীতি বের করতে পারেনি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র।
মাহমুদুর রহমানকে দন্ড দেয়ার গ্রাউন্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি অন্যায়, অবৈধ ও বেআইনি নোটিশে অনুতপ্ত হননি। বরং আদালতে দেয়া তাঁর বক্তব্যে শেখ হাসিনাকে কটুক্তি করা হয়েছে। এজন্যই ৩ বছরের দন্ড আর এক লাখ টাকা জরিমানা। দুর্নীতি দমন কমিশন, আমি যার নাম দিয়েছি আওয়ামী লীগের দুর্নীতি লালন কমিশন নোটিশ দিয়েছিল। সম্পদের হিসাব বিবরণি জমা দিতে বলা হয়েছিল এই নোটিশে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন আইন নামে একটি আইন রয়েছে। রয়েছে কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু বিধিমালা। যেই বিধিমালা গুলো মূল আইনের আওতায় তৈরি করা হয়েছে। কারো সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয়ার আগে আইন ও বিধিমালা গুলো অনুসরণ করতে হয়। মাহমুদুর রহমানের সম্পদের হিসাব চাওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন আইন এবং বিধির তোয়াক্কা করা হয়নি। অর্থাৎ নিজের আইন নিজেই লঙ্ঘন করেছিল কমিশন। এজন্য মাহমুদুর রহমান বেআইনি কার্যক্রমের কাছে মাথানত করেননি। তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন এই বেআইনি কার্যক্রমকে।
অনুসন্ধান বা তদন্তে কারো কাছে অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেলেই কেবল তাকে সম্পদের হিসাব দেয়ার নোটিশ দেয়া যায়, না দিলে দন্ড দেয়া যায়। আইনে সেটাই বলা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের কাছে কি এক পয়সার অবৈধ সম্পদ প্রাপ্তির প্রমাণ আদালতের রায়ে উল্লেখ আছে! রায়ে বলা হয়েছে সম্পদের নোটিশের বিষয়ে তিনি অনুতপ্ত না হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমন করে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই আক্রমণটা কি? আদালতে দেয়া বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান বলেছেন সরকার প্রধানের নির্দেশেই দুদক এই মামলা দিয়েছে। দুদক কারো নির্দেশ কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে পারে না। এই এখতিয়ার দুদকের নেই। শেখ হাসিনার নির্দেশে এই মামলা দায়েরের প্রমাণও মাহমুদুর রহমান তার আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যে আদালতে উপস্থাপন করেছেন। আদালতে দেয়া মাহমুদুর রহমানের বক্তব্য এবং তথ্য প্রমাণ গুলোই এর সাক্ষী। এগুলো বিচারক আমলে নেননি। মাহমুদুর রহমান সরকার প্রধানকে দায়ী করেছেন । এবং রায়ে সেটা উল্লেখ করে জানিয়ে দিলেন। তিনি মাহমুদুর রহমানকে ৩ বছরের কারাদন্ড দিলেন।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার একজন সংবাদ কর্মী হিসাবে কাজ করছি। সেই সুবাদে মাহমুদুর রহমানের মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব ছিল আমার উপর। মাহমুদুর রহমানের এই মামলা শুধু নয়,সকল মামলার আদ্যপ্রান্ত আমার জানা। মাহমুদুর রহমানের লেখনি এবং আমার দেশ পত্রিকার অবস্থানের কারনে শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই নানা পন্থা খুজছিল। ২০১০ সালে একবার মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পত্রিকাটিও জোর করে বন্ধ করা হয়েছিল তখন। সেই যাত্রায় শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছিলেন। পত্রিকা বের হয়েছিল। তবে মাহমুদুর রহমান এবং আমাকে সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমে একটি দন্ড দিতে সক্ষম হন তিনি। যদিও সুপ্রিমকোর্ট তখন তাদের শপথ বিরোধী অবস্থানের কিছু নমুনা রেখেছিলেন। এই নমুনার একটি হচ্ছে শুনানী চলাকালে মাহমুদুর রহমান তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করলে বিচারপতিরা বলে উঠেন-‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। এর ব্যাখ্যা স্পস্ট করে আবার বলে উঠেন-‘আমরা এখানে সত্য মিথ্যা যাছাই করতে বসিনি।’ এতেই স্পস্ট সেদিন দন্ড কেন দেয়া হয়েছিল।
এবার উচ্চ আদালতে নয়। এবার মাহমুদুর রহমানকে দন্ড দেয়া হয়েছে জেলা জজ আদালতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কোর্টে। এই মামলাটির সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই। মাহমুদুর রহমানের সম্পদের সন্ধানে চিরুনি অভিযান চালিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। দেশের সকল ব্যাংকের সকল শাখায় চিঠি দেয়া হয়েছিল। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছিল মাহমুদুর রহমানের কোন ব্যাংক একাউন্টি আছে কি না। থাকলে কতটা টাকা রয়েছে। এতে সরকার পরাজিত হয়। কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
চিঠি দেয়া হলো শেয়ার মার্কেটের সরকার ব্রোকার হাউজে। মাহমুদুর রহমানের নামে শেয়ার মার্কেটে কোন অ্যাকাউন্ট থাকলে তথ্য দিতে বলা হলো। একজনকে এই নামে এবং বাবার নামে মিল পাওয়া গেল। সরকার নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু এই অ্যাকাউন্টটিতে মাত্র ৫ লাখ টাকার ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ছিল। কিন্তু সেটাও যে মাহমুদুর রহমানের নয় পরে প্রমানিত হল। অর্থাৎ মাহমুদুর রহমানের নামে আয়কর নথিতে উল্লেখিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বাইরে কোন অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেল না। শেয়ার মার্কেটে কোন অ্যাকাউন্ট এবং বিনিয়োগের প্রমানও পেল না সরকার। এই চিরুনি অভিযানে খুশি হতে পারেনি সরকার। যে কোন উপায়ে মাহমুদুর রহমানের গায়ে কালিমা লেপন করতে হবে। এজন্য রয়েছে শেখ হাসিনার অনুগত দুদক। এই দুদকে প্রথমে বেআইনি চিঠি পাঠানো হল। বেআইনি চিঠি অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তাই দুদক নিজেই একজন অভিযোগকারী আবিস্কার করলেন। যাকে আবিস্কার করলেন সেই ব্যক্তিটিও কাল্পনিক ছিল। যদিও নাম এবং ঠিকানায় দেখানো হয়েছিল আমার দেশ ছাপাখানায় কর্মরত। কিন্তু ভূয়া ব্যক্তিটি আমার দেশ ছাপাখানায় আদৌ ছিলেন না। তারপরও সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার নোটিশ দিল দুদক। সেই থেকে মামলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু।
দুদুকের মামলার বাদী নূর আহম্মদ আদালতে দেয়া জবানবন্দির জেরায় স্বীকার করেছেন তদন্ত এখনো চলছে। অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে যা শুরু হয়েছিল সেটা সমাপ্ত হয়নি এখনো। জেরায় তিনি আরো স্বীকার করেছেন এপর্যন্ত তদন্তে মাহমুদুর রহমানের কোন অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপরও বিচারক তাঁকে দন্ড দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’ বলে দন্ড দিতে পারলে জেলা জজ পারবেন না কেন! মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়নি তো কি হয়েছে! অজুহাত তো আছে। সেটা হচ্ছে অন্যায়ের কাছে মাথানত করে অনুতপ্ত না হওয়া এবং শেখ হাসিনাকে কটুক্তি করা। দুদকের নোটিশের জবাব না দেয়া।
এই রায়ের পরও মাহমুদুর রহমান চ্যালেঞ্জ করছেন বাংলাদেশের কোন মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে এক পয়সার দুর্নীতির প্রমান দিতে পারবে না। শুধু দুদক কেন, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সকল মানুষ মিলেও তাঁর দুর্নীতি বের করতে পারবে না। কারন তিনি জীবন যাপন করেছেন সততা, ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে। তাই অন্যায়, অবিচার, জুলুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন অকপটে। লড়াই করছেন ইন্ডিয়ান আধিপত্যবাদ এবং কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে। এই রায়ের পরও তিনি ঘোষনা করেছেন তাঁর এ লড়াই অব্যাহত থাকবে।
লেখক: দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।