অধ্যাপক নজরুল হাবিবী, লন্ডন থেকে: দেশে যখন ভার্সিটিতে ছিলাম তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল পিএইচডি করব। মনে হত এটি জীবনের বড় অর্জন। আবার ভাবতাম বিষয়টি আমার জন্য নয়। কঠিন বাস্তবতার নাম এই পিএইচডি। আবার কে যেন শক্তি দিত। সহজ মনে হত। দেশে থাকতেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধীনে পিএইচডি করার এক দুরাশা মনের মধ্যে উঁকি দিত। নিছক কল্পনা বিলাস।
স্কুলে যেতাম না বলে ভায়েরা রাগ করতেন, মারতেন। তাদের ভয়ে ঘরের বাইরে শুধু দিন নয় রাতও কাটিয়েছি। ক্ষুধার্ত। মায়ের আঁচল ছিল লুকানোর একমাত্র সহায় ও সম্বল । মা লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের কোনো কোণায় অন্ধকারে আমাকে খেতে দিতেন । জীবনে কিছুই হলাম না বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁদতেন।
আমি সহজ অর্থে ভালো ছাত্র ছিলাম না। কঠিন অর্থে শিক্ষকের পাঠদানের নিয়মাবলীর উপর আমার আস্থা ছিল না । সিলেবাস বা গৎ বাঁধা কারিকুলাম আমার কখনো পছন্দের ছিল না বলে স্কুলে না গিয়ে মারবেল বা ডাংগুলি খেলে সময় কাটানোকে ভালো মনে করতাম। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উঠেছিলাম বাবার দোয়া এবং দয়ায়। ‘দয়া’ বলেছি এ জন্য যে, বাজারে আমাদের একটি বেকারী ছিল, আমার স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে কেউ দোকানে এলে বাবা তাদের বিস্কুট-টিস্কুট ‘উপহার’ দিতেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে গিয়ে দেখি আরেক মসিবত। গনিতের শিক্ষক ছিলেন রাউজানের হাজী পাড়া গ্রামের কবির আহমদ স্যার। নরম স্বাস্থ্যের গরম মানুষ। প্রচুর মার ধর করতেন, না মারলে যেন উনার হাত চুলকাত।
বলা যায়, কবির স্যার এর বেতের ব্যথায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। অনীহা চলে আসে স্কুলের প্রতি। অন্যদিকে হিন্দু বুদ্ধ মন্দিরে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়, তাদের সভা ও পূজা-মন্ডপে কবিতা আবৃত্তি, গান গাওয়া, বক্তব্য রাখা অথবা নাটকে অভিনয় আমার নেশায় পরিনত হয়। আমাদের একটি নাট্য সংস্থা ছিল। আমি ছিলাম সংগঠনের সভাপতি , জসিম উদ্দিন সবুজ এর সাধারণ সম্পাদক। সে এখন আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সদস্য। অবশ্য এর মূল প্রেরণায় ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার আর্টিস্ট রফিকুল ইসলাম। তিনি নাটক লিখতেন আমি অভিনয় করা সহ নাটকের জন্য গান লিখতাম। অবশ্য, আমিও অনেক নাটক লিখেছি যা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমার মনে পড়ে, আমার আকদের দিন মানে আকদ পড়ে বাড়িতে না গিয়ে আমি বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাউজান কলেজ মাঠের বিজয় মঞ্চে নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আমাদের নাটকের নাম ছিল ‘বিয়াদবি মাফ করবেন’।
এ সব দেখে বড় ভাইয়েরা জানিয়ে দিলেন যে, লেখা পড়া আমার জন্য নয়, আমি যেন বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করি ।
সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রাম থেকে কোনখানে পালিয়ে যাব। যেখানে উম্মুক্ত বাতাস আর বিমুক্ত আকাশের নীচে পাখি ও প্রজাপতির পিছনে ছুটতে পারবো। গাইবো, ঘুড়ি উড়াবো কেউ মানা করতে যাবে না, যেখানে থাকবে না ধরা বাঁধা কোন সিলেবাস এবং বেত।
একদিন পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাই। ক্যাশবাক্সে রেখে যাই একটি চিরকুট। আমার মেজ ভাই সে চিরকুটের ভাষা শৈলীর প্রশংসা করেছিলেন।
রাঙামাটির মারিশ্যা। মাদ্রাসা সমেত এতিম খানা। সেখানে তিন বছর ছিলাম। বালিশ ছিল ইট আর ব্লাংকেট ছিল ছেঁড়া পাটের বস্তা। আমার কোন কষ্ট ছিল না । কারণ, আমি আমার জীবনকে জানতাম এবং চিনতাম।
সেখান থেকে চলে আসি রাঙ্গুনীয়ার রাণীর হাট মাদ্রাসায়। সেখানে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকা কালীন আমি রচনা করি জীবনের প্রথম কবিতা-‘বসন্ত বাতাস’। এক পর্যায়ে আমি বিতর্কিত নাটক মঞ্চস্থ করার অপরাধে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হই। সে সুযোগে চষে বেড়াই পুরো বাংলাদেশ।
আমার জীবনের প্রাথমিক শিক্ষক আমার মা। আমার মনে হয় সেই ছোট বেলায় মা আমাকে অ-তে অক্সফোর্ড শিখিয়েছিলেন। আমার লেখা 18 টি বই এর মধ্যে একটি বই এর নাম -‘মা’। এই বইতে ‘অ- তে অক্সফোর্ড’ নামে একটি কবিতা আছে।
স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সপরিবারে যখন ইংল্যান্ডে চলে আসি তখন উচ্চ শিক্ষার জন্য আমার উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বহ গুণে বেড়ে যায়। এই তো জীবনের মহা সুযোগ।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, অন্য কোন দেশে হলিডেতে যাবার আগে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি দেখতে যাব। ক্যামব্রিজ আমার কাছে হওয়ায় সর্বপ্রথম আমি আমার স্ত্রী এবং মেয়ে অক্ষরকে নিয়ে ট্রেনে করে ক্যামব্রিজে যাই। আমার সে কী আনন্দ! শুধু ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে ঘুরেছি আর ছবি তুলছি। মনে পড়ে, আনন্দের আতিশয্যে, আমার পড়ালেখার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আমি এমন কিছু অসংলগ্ন কথা বলেছিলাম যা শুনে আমার স্ত্রী বলেছিল “তুমি একদম বাচ্চার মত”।
আমার মেয়েকে নিয়ে তার পরের মাসেই যাই অক্সফোর্ডে । সেখানে দুই দিন এক রাত ছিলাম। অক্সফোর্ড শুধু পড়াশোনার জন্য নয় প্রকৃতিগত ভাবেই মনোলোভা, মনোহরা এক স্বর্গীয় সমাবেশর নাম। চারিদিকে গাছপালা, লতা পাতা, শত বা হাজার বছরের পুরোনো ঘর আর বাড়ি, অদ্ভুত সুন্দর পরিপাটি দেয়াল, আবার মনে হবে কোন অদক্ষ হাতের ভুলে ভরা ইটের গাঁথুনি, অবিন্যস্ত ঘরের সারি যেমন গ্রাম- বাংলার কোন লাজুক রূপসী ললনা মাথা নিচু করে বসে আছে তার কাঙ্ক্ষিত মনের মানুষটিকে বহুদিনের না বলা কথাটি বলতে।
আমরা গাছপালা কেটে আনন্দ পাই। অক্সফোর্ডের ঘর গুলি অজানা অচেনা লতায়, ঘাসে, ফুলের চারায় মোড়ানো। এ সব শাড়ি পরা পরীর পল্লী ঘেষে ঘেষে কুলুকুলু প্রবাহিত স্বচ্ছ সলিলের খাল, নদী ও নালা। চোখ জুড়ানো মন ভুলানো অক্সফোর্ডের প্রাকৃতিক পরিচয় শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ প্রবন্ধের মাধ্যমে আমি প্রাসঙ্গিক দুটি কথা বলার সুযোগ গ্রহণ করেছি মাত্র।
প্রথম পর্ব: চলবে—