Home সাহিত্য আমরা ডাক্তাররা কী করিব?

আমরা ডাক্তাররা কী করিব?

745
0

নাজিরুম মুবিন: সোমনাথ আর বিনায়ক। স্কুলের বন্ধু। দুজনই ডাক্তার। চাকরি নিয়ে ইংল্যান্ড যায় একসাথে। সেখানে পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী বাসবীর সাথে তাদের পরিচয় হয়। বাঙ্গালী কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ করে মেয়েটা।
সোমনাথ যেদিন টের পায় বাসবী তার দিকেই বেশি ঝুঁকছে সেদিনই জানিয়ে দেয়, সে বিবাহিত। বন্ধু বিনায়ককে সুযোগ করে দেয় বাসবীর সাথে মেলামেশা করার। কিছুদিনের মধ্যে বিনায়কের সাথে বাসবীর বিয়ে হয়ে যায়।
কলকাতায় ফিরে এসে দুই বন্ধু ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেখাসাক্ষাৎ নেই বললেই চলে।
সরকারের নতুন নীতি, কলকাতার ডাক্তারদের মফঃস্বলের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে কমপক্ষে ৩ বছর পড়াতে হবে। বিনায়ক আর সোমনাথের পোস্টিং হয় বাঁকুড়ায়। দুই বন্ধু আবার একসাথে। একই বাসায় উঠবে এমনটাই স্বাভাবিক। বিনায়ক বাসবীকে সাথে এনেছে। কিন্তু এখানেও সোমনাথ তার স্ত্রীকে আনতে পারেনি। এ কারণে সে সপ্তাহে ৩ দিন বাঁকুড়ায় থাকে আর বাকিদিন কলকাতায় স্ত্রী-সন্তানদের সময় দেয়। চেম্বার করে।
বিনায়ক এখানে একটা চেম্বার খুলেছে। এর মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়। দারুণ ব্যস্ত। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়। কোন রাতে ফিরেই না। বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়া চলে যায়। অপারেশন করে। পেট থেকে গুলি বের করে। পরের দিন সকালে মোটা অংকের টাকা হাতে ফিরে।
বৃষ্টির শব্দ মাখা মোহময় এক রাতে, বিনায়ক রোগি দেখতে গিয়েছে। স্ত্রী-সন্তান বাসায় একা রেখে। বঞ্চিত বাসবী তার প্রথম ভালোলাগার দরজায় কড়া নাড়ে। সোমনাথ তাকে ফিরিয়ে দেয়। বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
বাসবী আবার বিনায়কের কাছে ফিরে আসে। সম্পর্কটাকে নতুন জীবন দিতে চায়, “চলো এবারের ছুটিতে আমরা ভূটান যাই।”
“দাঁড়াও। এখানে প্র্যাকটিস বেশ ভালো জমে উঠেছে। এক্ষুণি ছুটি নেওয়া যাবে না।” বিনায়ক বাসবীকে হতাশ করে।
বাসবী ঘরকন্যায় মন দেয়। “একটা কিছু তো করতে হবে। পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী ছিলাম, সে পড়াশোনা কোনই কাজে লাগলো না। এখন শুধুই হাউজ ওয়াইফ। আর হাউজ ওয়াইফ হয়েই যদি থাকতে হয়, তা হলে ভালো করে হওয়াই ভালো। রান্নাবান্না, সেলাই, ছেলে মানুষ করা, ঘর সাজানো…”
বাসবী রান্নার বই দেখে দেখে নতুন নতুন আইটেম বানায়। কিন্তু সেগুলো চেখে দেখার জন্য বিনায়ককে পাশে পায় না। বিনায়ক ব্যস্ত তার চেম্বারে।
নয় বছর পর।
সোমনাথ কলকাতার বেশ ব্যস্ত ডাক্তার। নাম শুনলেই অনেকে চিনে। বিনায়ক আরো বেশি ব্যস্ত। আরো বেশি খ্যাতিমান। সল্টলেকে মস্ত বাড়ি বানিয়েছে। সোমনাথ বাড়ি না বানাতে পারলেও গলফ গ্রীনে ফ্ল্যাট কিনেছে।
দাম্পত্য জীবনটাকে গুছিয়ে রেখেছে সোমনাথ। তার স্ত্রী শান্তা গান গায়। দুটো অ্যালবাম বেড়িয়েছে। সে নিজেও একসময় গান গাইতো। এখন চর্চা না থাকলেও গান-বাজনার কোন অনুষ্ঠান সে মিস করে না। চেম্বার বন্ধ রেখে শান্তাকে নিয়ে অনুষ্ঠানে চলে যায়।
বিনায়ক আগের মতোই পরিশ্রম করে চলেছে। কিন্তু শরীর তো মানতে চায় না। প্রতিবাদ করে। হার্ট অ্যাটাক হয় বিনায়কের। ভালমতো সুস্থ না হতেই আবার চেম্বার শুরু করে। এবার আরো বড় ধাক্কা খায়। বাসবী তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। বিনায়ক বাসবীকে থামাতে পারেনি। সে অধিকারটুকু ছিল না। বিগত নয়-দশ বছর তাদের মধ্যে কোন রোমান্স ছিল না। শুধু বাইরে স্বামী-স্ত্রীর ঠাট বজায় রেখে চলতো।
বিনায়ক সবই পেলো আবার কিছুই পেলো না। সল্টলেকের মস্ত বাড়ি খালি পড়ে রইলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘একটি রাতঃ তিনটি জীবন’ উপন্যাসিকা লিখেছেন নব্বই দশকের শুরুর দিকে। পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তারদের পারিবারিক সংকট উঠে এসেছে বিনায়ক এবং সোমনাথ চরিত্রের তুলনার মধ্য দিয়ে।
২০১৭তে বাংলাদেশে এই চিত্র এখনো বর্তমান। আমাদের চারপাশে শত-সহস্র বিনায়ক আছে। আমরা সবাই তাদের চিনি।
‘আমরা ডাক্তাররা কী করিব’ সিরিজের আজকের প্রশ্ন, এই সফল, কীর্তিমান প্রফেসর ডা. বিনায়ক স্যার হইয়া আমরা ডাক্তাররা কী করিব?

Previous articleজাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের মৃত্যুতে গোলাপ মিয়া শোকাহত
Next articleসরকারের উন্নয়নের কথা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে