Home সম্পাদকীয় কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে নাগরিকের দায়িত্ব

কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে নাগরিকের দায়িত্ব

1739
0

অধ্যক্ষ শিব্বির আহমদ ওসমানী: ইসলামের প্রধান দুটি আনন্দ উৎসব হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর ও ‘ঈদুল আযহা। আমাদের দেশে ঈদুল আজহাকে কোরবানির ঈদ বলা হয়। এ সময় যেহেতু সামর্থ্যবান মুসলমানরা পশু কোরবানি করে থাকেন তাই এ ঈদকে কোরবানির ঈদ বলা হয়। ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজ শেষে আমরা কোরবানি করি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যেমন, যাদের নামে কোরবানি দেয়া হচ্ছে, তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা। সুন্নত তরিকা অনুযায়ী পশু জবাই করা। জবাইয়ের জন্য ধারাল ছুরি ব্যবহার করা। জবাইকৃত পশুর রক্ত ফেলার জন্য আগেই গর্ত করে রাখা। গর্ত করা সম্ভব না হলে ড্রেন কিংবা উপযুক্ত কোনো জায়গায় রক্ত ফেলার ব্যবস্থা করা। তবে শহরাঞ্চলে গর্ত খুঁড়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বিদ্যুৎ/টেলিফোনের তার কাটা না পড়ে। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা একত্রে এভাবে কোরবানীর বর্জ্য মাটির নিচে পুঁতে এক বছরের বর্জ্য পরবর্তী বছর কোরবানীর আগেই উঠিয়ে জৈব সার হিসেবে শস্যক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন।

কোরবানির পর পশুর রক্ত ও তরল বর্জ্য খোলা স্থানে রাখা যাবে না৷ এগুলো গর্তের ভেতরে পুঁতে মাটিচাপা দিতে হবে৷ কারণ, রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দুর্গন্ধ ছড়ায়৷ আর যদি রক্ত মাটি থেকে সরানো সম্ভব না হয়, তা হলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে৷

কোরবানির বর্জ্য পলিথিনে রেখে দিতে হবে, যাতে ময়লা পরিবহন দ্রুততার সঙ্গে করা যায়৷ যাঁরা পলিথিন পাবেন না, তাঁরা এ রকম পলিথিন কিনে ময়লা রাখতে পারেন৷ যেসব এলাকায় ময়লার গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয় বা দেরি হবে, সেসব স্থানে বর্জ্য পলিথিনের ব্যাগে ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে৷ পশুর হাড়সহ শক্ত বর্জ্য গুলোও পলিথিনে দিয়ে দেওয়া ভালো৷ নাড়িভুঁড়ি বা এ জাতীয় বর্জ্য কোনোভাবেই পয়:নিষ্কাশন নালায় ফেলা যাবে না৷ যাঁরা চামড়া কিনবেন, তাঁরা কোনো বদ্ধ পরিবেশে চামড়া পরিষ্কার না করে এমন খোলামেলা স্থানে করতে পারেন, যেখানে ময়লা জমে দুর্গন্ধ হবে না৷ আর চামড়ার বর্জ্য গুলোও অপসারণের জন্য জমিয়ে রাখতে হবে৷ কোরবানির পশুর বর্জ্য নিজের উদ্যোগে পরিষ্কার করাই ভালো৷

পৃথিবীর সব ধর্মেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে শরীর সুস্থ রাখার জন্য যেসব পন্থা বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, তার মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। পোশাক-পরিচ্ছেদের পাশাপাশি ব্যবহার্য অন্যান্য সামগ্রী পরিচ্ছন্ন রাখাও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ধর্মসম্মত নিয়ম।

সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগে এগিয়ে আসা উচিত। সেই সঙ্গে অপসারিত বর্জ্যকে কল্যাণমুখী কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য আধুনিক পদ্ধতি এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করা খুবই জরুরী। সর্বোপরি আমাদের বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়াকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা প্রয়োজন, প্রয়োজন এর পরিকল্পিত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

“প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে অর্ধকোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র হজ পালন করতে সৌদি আরব গমন করেন। প্রায় দেড় মাস জেদ্দা, মক্কা-মদিনা, মুজদালিফা, মিনা এলাকায় অবস্থান করেন। সৌদিদের পাশাপাশি হাজীরা একাধিক কোরবানি করেন। সেখানে কোরবানির পশুর বর্জ্য সূর্য উদয়ের আগে অপসারণ করা হয়। সে দেশে কোনো কলেরা হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়নি। এক দল প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা বর্জ্য প্রযুক্তিবিদ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেন। আর আমাদের দেশে পশুর বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়া সঠিক পদ্ধদিতে না হওয়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও ডায়রিয়া রোগের বিস্তার ঘটায়।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে দেশের সব হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের হাত ধোয়া (হ্যান্ডওয়াশ) ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়ায় মাঝে-মধ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিবিদ্যায় ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকের অভাবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান থাকছে না। অদক্ষ ও অনিয়মিত প্রশিক্ষণ পরিচালনার ফলে বিপজ্জনক বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনার মত এ মহতী উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।

সরকারি, আধা সরকারি, সামরিক, পুলিশ বাহিনী, অফিস আদালত, সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় যেসব কর্মী সুইপার পদে নিয়োজিত, তাদের বর্জ্য অপসারণ, নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রশিক্ষণ না থাকায় সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সুতরাং ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

সরকার একটি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাই আসন্ন কোরবানিতে গরুর গোবর, আবর্জনা, কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্ট গন্ধ ছড়ানোর আগেই পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের এলাকা আমাদেরকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

মানুষের কল্যাণের জন্যেই সৃষ্টির শুরুতেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানা তায়া’লা জীব-জন্তুর মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলার শিক্ষাই দিয়েছেন। জীব-জন্তুর মৃতদেহের সৎকার করার এটাই সর্বোত্তম ও বিজ্ঞানসম্মত পন্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ বা জীবজন্তুর মৃতদেহ পানিতে ডুবিয়ে দেয়া বা পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার রীতি পরিবেশ দূষণ ও অর্থের অপচয় ঘটায় এবং এটা মানবিকতার পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়।

ইসলামের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ঘটনাটি হল, বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আ. এর ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে দ্বন্ধের ফলশ্রুতিতে কাবিল তারই আপন ভাই হাবিলকে আক্রমণ করে। কাবিলের আক্রমণে ভাই হাবিল মৃত্যুবরণ করেন। ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুতে কাবিল ব্যথিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং তাদের পিতা আদম আ. ঘটনাস্থলে আসার পূর্বেই কাবিল তার ভাইয়ের মৃতদেহ কি করবেন সে চিন্তায় মৃতদেহ নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। এমনি সময় মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়া’লা উক্ত স্থানে দু’টি কাক প্রেরণ করেন মানবজাতিকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে। কাবিলের সামনেই কাক দু’টি মারামারি করতে থাকে উহাতে একটি কাক মারা যায়। তখন জীবিত কাকটি পা দিয়ে মাটি খুঁড়ে মৃত কাকটিকে মাটির নিচে চাপা দেন। এ দৃশ্যটি কাবিল অবলোকন করেন এবং সে তার ভাইয়ের মৃতদেহ একইভাবে মাটির নিচে কবর দিয়ে মানবজাতির জন্যে একটি দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এ ঘটনা থেকে আমরা যে শুধুমাত্র মানুষ বা জীবজন্তুর মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলার/দাফনের শিক্ষাই পাই তা নয় বরং জীবজন্তুর দেহের অংশবিশেষ বা পচনশীল বর্জ্য যা পচে গেলে গন্ধ ছড়ায় সেগুলোও মাটির নিচে পুঁতে ফেলার শিক্ষা পাই। এ কল্যাণকর পন্থা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কমবেশি জ্ঞান আছে, তৎসত্ত্বেও অসচেতনতা/অবহেলার কারণে যত্রতত্র উক্ত আবর্জনা ফেলে আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করছি, নিজেদেরকেও ক্ষতিগ্রস্থ করছি।

কোরবানির পর যা করণীযঃ

* কোরবানির আগেই বাড়ির পাশে কোনো মাঠে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় একটা গর্ত তৈরি করে রাখুন।

* মাংস কাটার সময উচ্ছিষ্টগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন। কাজ শেষে সেগুলো গর্তে পুঁতে ফেলুন।

* পশুর ভুঁড়ি পরিষ্কারের পর সেই আবর্জনা খোলা অবস্থায় না রেখে সেই গর্তে পুঁতে ফেলুন।

* কোরবানির সব কার্যক্রম শেষে রক্তে মাখা রাস্তাঘাট ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন। জীবাণু যেন ছডাতে না পারে সে জন্য নোংরা জায়গা পরিষ্কারের সময় স্যাভলন মেলানো পানি ব্যবহার করুন।

* যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পশুর চামড়া বিক্রি কিংবা দান করতে হবে।

* শহরে যারা থাকেন তারা বিচ্ছিন্ন স্থানে কোরবানি না দিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে এক স্থানে কোরবানি করা ভালো। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ করতে সুবিধা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোরবানির জায়গাটি যেন খোলামেলা হয়। আর জায়গাটি রাস্তার কাছাকাটি হলে বর্জ্যরে গাড়ি পৌঁছাতে সহজ হবে।

* যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয় বা দেরি হবে, সেসব স্থানে বর্জ্য পলিথিনের ব্যাগে ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে।

কোরবানির পর আমাদের সচেতনতাই পারে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে। আমরা যেন শুধু পশু কোরবানির মাধ্যমেই ত্যাগ শব্দটি সীমাবদ্ধ না রাখি। আমাদের প্রত্যেকের বাস্তব জীবনে ত্যাগের অনুশীলন করতে হবে।

লেখক: অধ্যক্ষ শিব্বির আহমদ ওসমানী, প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ- সিলেট ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজ।

ই-মেইল: sahmedosmani@gmail.com

Previous articleমেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের রিট খারিজ
Next articleবাংলার মাটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব: মাহবুবুর রহমান