তানভীর আলম পিয়াস : যুদ্ধপরাধ বলতে যা বোঝায় তার প্রতিটি অপরাধই মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়েছে সিলেট অঞ্চলে। পাকহানাদার বাহিনীর পাশাপাশি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা এই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের ওপর যে বিভীষিকা চালিয়েছে তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। স্বাধীনতার শত্রুরা গণহত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালিয়েছে যুদ্ধের পুরো ৯টি মাস। এমনকি হাসপাতালের রোগী, ডাক্তার কেউই রেহাই পায়নি বর্বরদের হাত থেকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর সারাদেশের ন্যায় সিলেটের দালালদেরও তালিকা তৈরি হয়। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে, এই ঘোষণাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সময়ে গ্রেফতারকৃত অনেক দালাল- রাজাকার মুক্তি লাভ করে। যদিও সেই ঘোষণায় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত দালালদের ক্ষমা করা হয়নি। তারপরও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে নানা ঘটনা। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর শক্তিশালী হয়ে ওঠে দালালরা।
খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ক্রমান্বয়ে প্রায় সব দালালই ছাড়া পেয়ে যায়। অসংখ্য দালালকে পুনর্বাসিত করা হয়। বিভিন্ন স্থানে দালালরাই চলে আসে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। যার ফলে মানবতা বিরোধীরা চলে যায় আইনের আওতার বাইরে। হাসপাতালে হত্যাযজ্ঞ, হার মেনেছে সকল বর্বরতা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে হাসপাতাল নিরাপদ স্থান। কিন্তু পাক পশুর দল কোনো রীতিনীতি মানেনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হিটলারের বাহিনীর চেয়েও বর্বর হয়ে ওঠে তারা। #লাল হয়ে উঠেছিল শ্রীরামসীর আকাশ : ১৯৭১ সালে ৩১ আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামসীতে হানা দেয় হায়নার দল। শ্রীরামসী বাজারে পৌঁছেই উপস্থিত লোকদের ঘিরে ফেলে তারা। স্কুলে মিটিংয়ের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সে সময় পাক ক্যাপ্টেন সরাজ খানের নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার আহমদ আলী গ্রামের লোকজনকে মাইকিং করে জানিয়ে দেয় স্কুলে আসার জন্য; অন্যথায় তাদের অসুবিধা হবে। তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পালাবার পথ ছিল না। একমাত্র যাতায়াতের পথে শত্রুদের কড়া পাহারা থাকায় যারাই নৌকাঘাটে গেছে তাদেরকেই ধরে নিয়ে আসা হয়েছে স্কুলে। সব মিলিয়ে আটক করা হয় প্রায় দুই শতাধিক লোককে। স্কুল ঘরের নবম শ্রেণীর পাঠকক্ষে জড়ো করা হয় সবাইকে। পাক সেনাদের নেতৃত্বে সরাজ খান। শ্রেণীকক্ষে দু’জন করে পিঠাপিঠি হাত বেঁধে ফেলা হয় সকলের। ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আটককৃতরা। অভয় দেয় বিশ্বাসঘাতক পাক সেনারা। বলে- ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জগন্নাথপুর নিয়ে গিয়ে সবার বিচার হবে। তারপর সবাইকে ছেড়ে দেয়া হবে।’ বাধা পড়া লোকদের কেউই জানেন না- কেন তাদের বাধা হয়েছে, বিচারই বা কিসের হবে! এমন সময় রাজাকার কমান্ডার আহমদ আলী এসে কক্ষে প্রবেশ করে কথা বলে সরাজের সাথে। মুক্তিকামী মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে সে। এরপর সেখান থেকে পশুর মতো টেনে হিঁচড়ে বেঁধে রাখা লোকজনকে নিয়ে যাওয়া হয় নৌকাঘাটে। দুটি নৌকাতে করে দু’দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। (পরের স্ট্যাটাস এ দেখুন)আহমদ আলীর নিকটাত্মীয় মছরব উল্লার বাড়ির পুকুরপাড়ে গিয়ে থামানো হয় একটি নৌকা। একে একে নৌকা থেকে নামানো হয় হাত বাঁধা লোকদের। এসেম্বলির লাইনের মতো লাইন করে দাঁড় করানো হয় সবাইকে। তারপর শ্রীরামসী শুনল টানা গুলির শব্দ। এই পুকুরপাড়েই এক সাথে হত্যা করা হলো ৪৬ জনকে। অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া নৌকাগুলোকে স্থানীয় আব্রু মিয়ার বাড়ির সামনে দাঁড় করানো হয়। এরপর পাক সেনারা পুকুরের পাশেই দাঁড় করা নৌকার ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখান থেকে কেউই পালাতে পারেননি। একেএকে গুলি করে হত্যা করা হয় ৯৩ জন মুক্তিকামীকে। শুধু হত্যাযজ্ঞ চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পাক সেনা আর তাদের দোসররা। এরপর বাজার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে চালানো হয় লুটপাট। লুটপাটের কাজটি শেষ হলে কেরোসিন ঢেলে বাজার ও গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয় বাজার-গ্রাম। দিনের আলোতে লাল হয়ে ওঠে শ্রীরামসীর আকাশ।
রানীগঞ্জে নদীর জলে ভেসে যায় শহীদদের লাশ : ১৯৭-এর ১ সেপ্টেম্বর জগন্নাথপুর উপজেলার রানীগঞ্জে আসে হায়েনার দল। তারা বাজারে জড়ো হওয়া লোকজনদেরকে শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে কুশিয়ারার তীরবর্তী একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানীদের নির্দেশ অনুযায়ী দেশীয় দালালরা মুক্তিকামী প্রায় দুই শ’ বাঙালীকে বেঁধে ফেলে। গ্রুপভিত্তিক বাঁধা হয় লোকজনদেরকে। প্রথমে সারিবদ্ধভাবে ৫-১০ জন করে বাঁধা হয় তরুণদের। এরপর তাদের নিয়ে দাঁড় করানো হয় নদীর একেবারে তীরে। পর্যায়ক্রমে গুলি করে হত্যা করা হয় অসংখ্য নিরপরাধ বাঙালীকে। হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে। অসংখ্য লাশ ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা। সে কারণে রানীগঞ্জে মোট কতজন লোককে হত্যা করা হয় এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এর পেছনেও অন্য একটি কারণ ছিল। তা হচ্ছেÑ যাদেরকে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে স্থানীয়দের চেয়ে অস্থানীয়দের সংখ্যাই ছিল বেশি। স্থানীয়ভাবে ৪০ জনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। আর সেই লাশগুলোকে আত্মীয়- স্বজনরা পারিবারিক অথবা গ্রামের কবরস্থানে নিয়ে দাফন করেন। রানীগঞ্জ হত্যাযজ্ঞের পাকিস্তানীদের নেতৃত্বে ছিল পাক ক্যাপ্টেন সরাজ খান। আর স্থানীয় দালালদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।