ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের শৈলকুপায় জমিদারদের জমিদারি নেই। আছে সেযুগের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র কলের গান আর বেশ কিছু প্রাচীন প্রত্মনিদর্শন। শৈলকুপার আবাইপুরে রামসুন্দর শিকদারের শিকদার স্ট্রিট জমিদারির পতন হয়েছে অনেক আগে। ৪শ বিঘা জমির ওপর নির্মিত জৌলুসপূর্ণ রাজ প্রাসাদের ভাঙাচোরা (ধ্বংসাবশেষ) দালানের এক কোণে এখন বাস করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদারের বংশধরেরা। চরম অভাব-অনটনের মধ্যেও তারা সযতে আঁকড়ে রেখেছেন সে যুগের একটি বৃহত গ্রামফোন (কলের গান), পাথরের তৈরি হুক্কা, একখানা তরবারি, প্রাচীন আমলের শ্রীমদ্ভাবতম্, বাদ্যযন্ত্র এসরাজ, সাল কাঠের তৈরি পুরাতন দুটি মন্দির ও রূপার তৈরি জরির নকশা করা বেনারসি শাড়ির অংশবিশেষ।
জমিদারি বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ১২শ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে অবিভুক্ত ভারতবর্ষের যশোর জেলার আবাইপুর এলাকায় শিকদার স্ট্রিট’র জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদার। বংশটির আদি উপাধি ছিলো তিলিকুণ্ডু সম্প্রদায়। রামসুন্দর শিকদারের ঠাকুর দাদা কার্তিক চন্দ্র শিকদার ছিলেন চাল ব্যবসায়ী। তৎকালীণ সময়ে চালের ব্যবসা করে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন। ব্যবসার সফলতার কারণে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার থেকে তিনি শিকদার উপাধি লাভ করেন। রামসুন্দর পৈত্রিক নিবাস শৈলকুপার আবাইপুরে প্রায় ৪শ’ বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলেন বিশাল এক প্রাসাদ। জমিদার বাড়ির চারিদিকে ঘুরানো দালানে রুম ছিলো প্রায় সাড়ে ৩শ। তৎকালীন সময়ে এখানে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস স্থাপনসহ এক বড় বাজার গড়ে তোলেন তিনি। অজপাড়াগাঁয়ে স্থাপন করেন থিয়েটার হল এবং এখানেই তিনি তার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইতিহাসে শিকদার স্ট্রিট নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য ১৯২৪ সালে সাব রেজিস্ট্রার অফিসটি উঠে যায়। বাংলা ১২৭০ সালের ২৫ বৈশাখ পরলোকগমণ করেন জমিদার রামসুন্দর শিকদার। মৃত্যুকালে তিনি ৭ পুত্র সন্তান রেখে যান। তারা হলেন- মীরমাধব, বেণীমাধব, যাদব, অক্কুর চন্দ্র, ক্ষেত্র, দ্রুব ও বীরসুম্ভার। রামসুন্দরের রেখে যাওয়া জমিদারি ও ব্যবসা তার ছেলেরা দেখাশুনা করতে থাকেন। বাংলা ১৩০৪ সালে পাটের ব্যবসা শুরু করে তারা আরো প্রতিষ্ঠা পান। তৎকালীন সময়ে কোলকাতায় শিকদার অ্যান্ড কোম্পানির নামে তারা পাটের ব্যবসা শুরু করেন।
১৩১৯ সালে কোম্পানিটির ট্রেডমার্কের পাট বিলেতের ডাণ্ডিতে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়। সে সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন শিকদার অ্যান্ড কোম্পানিকে প্রিন্স অব জুট বেলার্স উপাধি দেন। তারপর জমিদারি ব্যবসা বাণিজ্য ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায় শরিকদের মধ্যে। বংশের লোকেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পরিবারের লোকেরা বিলেত ও আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। অনেকে সরকারি চাকরিতেও যোগ দেন। রামসুন্দরের ভাইপো বনবিহারী শিকদার অবিভুক্ত ভারত বর্ষের রেলওয়ে বিভাগের প্রথম বাঙালি ডিটিএস হিসেবে নিযুক্ত হন। রামসুন্দর শিকদারের মৃত্যুর ২৫ বছর পর আবাইপুরে রামসুন্দর ইনস্টিটিউট নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তার পুত্ররা। এরপর কালের বিবর্তনে আবাইপুরের শিকদার স্ট্রিট ধ্বংস হয়ে যায়। বিলুপ্ত হয় জমিদারি। রামসুন্দরের পৈত্রিক শৈলকুপা উপজেলা শহরের ১৭ কিলোমিটার পূর্বে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা আবাইপুর। যেখানে রামসুন্দরের পৈত্রিক ভিটা দ্বিতল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। বিরাট এলাকা নিয়ে বাড়িটির অবকাঠামো। তবে কালে কালে তা জবরদখল হয়ে গেছে। দখলবাজরা রাজ বাড়ির অনেকাংশ ভেঙে ভেঙে একটি থেকে একটি আলাদা করে ফেলেছে। লুট হয়ে গেছে বাড়ির সরঞ্জামাদি (লোহা ও কাঠের তৈরি)। বিশাল এ রাজবাড়িটির উত্তর দিকের একটি ভবনে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম চলে। আর পশ্চিম দিকের একটি ভবনের একাংশে বসবাস করছেন জমিদার রামসুন্দর শিকদারের ৫ম পুরুষ অভিভূষণ শিকদার, রাজকুমার শিকদার ও অনিমেশ শিকদার। তারা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জমি-জমিদারি প্রাসাদ ধন-সম্পদ রক্ষা করতে না পারলেও বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কিছু মূল্যবান প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি সচল বৃহত গ্রামফোন (কলের গান), পাথরের তৈরি হুক্কা, একখানা তরবারি, প্রাচীন আমলের শ্রীমদ্ভাবতম, বাদ্যযন্ত্র এসরাজ, সাল কাঠের তৈরি পুরাতন দুটি মন্দির ও রূপার তৈরি জরির নকশা করা বেনারসি শাড়ির অংশবিশেষসহ বেশ কিছু প্রততাত্ত্বিক নিদর্শন যা রামসুন্দরের উত্তরসুরি রাজকুমার শিকদারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সেযুগের এসব মূল্যবান নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা উচিত বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।