নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বুড়িগঙ্গা নদীতে গতকাল দুপুরে এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বসুরচরে গত বুধবার রাতে দু’টি ট্রলারডুবিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ও আটজন নিখোঁজ রয়েছেন। ট্রলার দু’টির একটি চাঁদপুরের মতলবে সোলায়মান শাহ ওরফে লেংটার মেলায় যাওয়ার পথে এবং একটি ফিরে আসার পথে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়।
নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পাগলার আলীগঞ্জের খেয়াঘাটসংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে গতকাল বেলা ১টায় ট্রলারডুবির ঘটনায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আরো একজন নারী। নিহত ও নিখোঁজ সবার বাড়ি ঢাকার মিরপুর ও লালবাগ এলাকায়। চাঁদপুরের মতলবে সোলায়মান শাহ ওরফে লেংটার মেলা শেষে ট্রলারে এসব লোকজন ঢাকার সদরঘাটে ফিরছিলেন। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে।
সন্ধ্যা ৬টা শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতরা হলেনÑ ঢাকার লালবাগের ১৭৪ সৈয়দনগরের মৃত লাটমিয়ার ছেলে মো: ছমির হোসেন (৪৫) ও একই এলাকার আব্দুল হক ওরফে ওহাব মাতবরের ছেলে রুবেল (১৮), হাফেজ মিয়ার ছেলে রুবেল (৩০), মো: নিজামের ছেলে সাগর (১০), মিরপুর সিনেমা হল এলাকার নুরউদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন (৩০), লালবাগ এলাকার কাজল মিয়া (২৮), করমজান বিবি (৬৫) ও স্বপন মিয়া (২২)। এ ছাড়া নিখোঁজ মহিলার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ট্রলারের যাত্রী মো: রিপন জানান, দুই দিন আগে ট্রলারটি ভাড়া করে মতলবে মেলায় যান তারা। ওই মাজার ও মেলা থেকে যাত্রী নিয়ে গতকাল সকাল ৮টার দিকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয় ট্রলারটি। নারায়ণগঞ্জের পাগলার আলীগঞ্জ এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বালুবাহী ট্রলার তাদের ট্রলারে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রলারটি ডুবে যায়।
ট্রলারের অপর যাত্রী আবু সিদ্দিক জানান, নদীতে বালুবাহী বাল্কহেড ‘সাথীবুল বাহার ২’ এর ধাক্কায় ট্রলারটি ডুবে যায়। আশপাশের লোকজনের সহায়তায় অনেকেই সাঁতরে তীরে উঠতে সম হন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা জানান, ঘটনাস্থলটি কেরানীগঞ্জ হলেও ট্রলারডুবির ঘটনার খবর পেয়ে ফতুল্লা থানা পুলিশ ও কোস্টগার্ড উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তিনি আরো বলেন, ঘটনাস্থল ঢাকা জেলার দণি কেরানীগঞ্জ হওয়ায় ও নিহতের সবার বাড়ি ঢাকাতে হওয়ায় তাদের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া নিতে চাইলে স্বজনদের ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করতে হবে।
এ দিকে দুর্ঘটনার পর নদীর তীরে শত শত নারী পুরুষ আহাজারি শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার কার্যক্রম চালায়। দুর্ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর বিকেল ৩টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ডুবে যাওয়া ট্রলারটি উদ্ধার করে। এ ছাড়া নদীর বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি করে একে একে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। বিকেলে ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ কেরানীগঞ্জ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। নিহত পরিবারকে দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়।
দুর্ঘটনার সময় টলারের যাত্রীরা ঘুমিয়েছিল বলে জানান বেচেঁ যাওয়া যাত্রীরা। সারা রাত অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। সেই কারণে গতকাল সকাল ৮টায় যখন মতলবের সোলায়মান শাহ ওরফে লেংটার মাজারের ঘাট থেকে ট্রলারটি ছাড়ে তখন অনেকেই ঘুমিয়ে ছিল। ট্রলারটি পাগলার আলীগঞ্জে আসার পরেই বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বালুবাহী বাল্কহেড ধাক্কা দেয়। আর মুহূর্তের মধ্যেই ট্রলারটি ডুবে গেলে আর সেই ঘুমের মধ্যেই অনেকে চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন প্রত্যক্ষদর্শী ও ওই ট্রলারে থাকা সাদেক মিয়া। তিনি ঢাকার লালবাগ এলাকাতে একটি জুতার দোকানের কর্মচারী। দুই দিন আগে তারা ট্রলারে করে যান মতলবের মেলাতে।
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, ঝড়ো-হাওয়ায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বসুরচর গ্রামসংলগ্ন মেঘনা নদীতে বালুভর্তি বাল্কহেড ও যাত্রীবাহী ট্রলারের মধ্যে সংঘর্ষে ডুবে যাওয়ায় ট্রলারের যাত্রী পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় আরো নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত পাঁচ-সাতজন। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত শিশুসহ চারজনের লাশ মেঘনায় ভেসে উঠলে ডুবুরিরা তা উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে একটি শিশু ও চারজন পুরুষ রয়েছেন।
জানা যায়, গত বুধবার রাত ৮টায় গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়া ফেরিঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৫০-৬০ জন যাত্রী চাঁদপুরের মতলব (উত্তর) থানার বেলতলী সোলায়মান ফকির লেংটার মাজারে যাওয়ার পথে বসুরচরসংলগ্ন মেঘনা নদী অতিক্রম করার সময় ‘মা বাবার দোয়া’ নামের বালুভর্তি একটি বাল্কহেড যাত্রীবাহী ট্রলারটিকে ধাক্কা দিলে মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। এ সময় ১০-১২ জন যাত্রী নিখোঁজ হন। নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে গতকাল ভোর থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত চার যুবকের লাশ (তাদের বয়স ২২-৩৪) ও এক কন্যাশিশুর (৪) লাশ উদ্ধার হয়েছে। শিশুর নাম মারিয়া। মারিয়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার মনির হোসেনের মেয়ে। অপর চার যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি।