সরফ রাজ জুবের: ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী গ্রামের শতাধিক স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে মিটিংয়ের অজুহাতে ডেকে আনা হয়। মিটিংয়ের নামে ডেকে এনে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৫৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহায়তায় এদের হত্যা করা হয়। এ নারকীয় ঘটনার পরদিনই একই উপজেলার নৌ-বন্দরখ্যাত রানীগঞ্জ বাজারে আরেকটি গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হায়েনারা। সেখানে প্রায় ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ দুটি স্থানেই স্বাধীনতা- পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয়ভাবে গঠিত হয় বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটি। এ কমিটি প্রতি বছর বিশেষ বিশেষ দিবসে শহীদদের শ্রদ্ধা জানায়। আয়োজন বলতে কেবল এটুকুই। নেই গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ। অবহেলা ও অযত্নে নির্মিত স্মৃতিসৌধও পড়ে আছে করুণ দশায়। সিলেট বিভাগের এ দুই গণকবরে সরকারিভাবেও পালিত হয় না কোনো অনুষ্ঠান। কোনো সীমানা দেয়াল না থাকা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গণকবরগুলো পরিণত হয়েছে গো-চারণ ভূমিতে। শ্রীরামসীতে গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন স্থানীয় যুবক তৈয়ব আলী শ্রীরামসি গ্রামের বাসিন্দা আমার পিতামহ| দেশ স্বাধীন হয়েছে। তবু আক্ষেপ ঘোচেনি ‘সেদিন এলাকার তরুণদের ধরে ধরে এনে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। সেদিন রক্তের বন্যায় ভেসে যায় গ্রাম।’
হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা করা হয় গ্রামের শতাধিক লোককে। এত লোক প্রাণ দিলেও আজ তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। তাদের নাম শুধু স্মৃতিসৌধের তালিকায়ই লেখা আছে। আর কোথাও নেই। কেউ খোঁজও নেয় না। একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটা এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।’
শ্রীরামসী গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হুসিয়য়ার মিয়া জানান, সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার সময় ১০-১২টি নৌকায় করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা শ্রীরামসী বাজারে আসে। তারা এলাকাবাসীকে নির্দেশ দেয়, সবাই যেন শান্তি কমিটির সভায় অংশ নেয়। অস্ত্র তাক করা আদেশের মুখে অসহায় ও নিরস্ত্র গ্রামবাসী শ্রীরামশী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শান্তি কমিটির কথিত সভায় উপস্থিত হতে থাকে। যাদের আসতে দেরি হয়, তাদের চিহ্নিত করা হয়। একপর্যায়ে দেরি করে আসা লোকদের হাত-পা পেছন দিক থেকে বেঁধে ফেলা হয়। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি আর্মিরা রাজাকারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে তাদের নৌকায় নিয়ে গিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই পানিতে ঝাঁপ দেয়। পরে তাদের পানি থেকে তুলে গুলি করে হত্যা করা হয়।
[লেখক: সরফ রাজ জুবের, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছাত্রনেতা]