ইসলামি সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য একত্ববাদ

0
1003
blank
blank

শাহ্ আব্দুল হান্নান: যেকোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা যেকোনো আন্দোলনের পেছনে একটি দর্শন থাকার প্রয়োজন আছে। কোনো বড় আন্দোলন, বড় বিপ্লব বা বড় পটপরিবর্তন হয় না, যদি তাতে কোনো তত্ত্ব না থাকে। আমি সে তত্ত্বের দিকে গিয়েই দু-একটি কথা সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।
আমি দেখছি, বিশ্বব্যাপী একটি নৈতিক সঙ্কট চলছে। একটি নৈতিক অবক্ষয় চলছে। এ নৈতিক অবক্ষয়ের প্রমাণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বর্বরতা। সেটি আফগানিস্তানে হোক, ইরাকে হোক, সিরিয়ায় হোক, কাশ্মিরে হোক কিংবা অন্য কোনো দেশে হোক। হিংস্রতা, ধ্বংস, হত্যা, অত্যাচার, এমনকি সন্ত্রাস কোনোটিই মানবজাতির জন্য কল্যাণকর নয়। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সন্ত্রাস মানবতার শত্রু। আমি জানি, এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে ইসলাম এবং মানবতাবাদের। আমি মনে করি, সব ভালো লোকের, এমনকি সংস্কৃতিসেবীর এবং সব সংস্কৃতিকর্মীর এ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। ক্রুয়েলিটির বিরুদ্ধে, বার্বারিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং সেই সাথে বিশ্বব্যাপী যে নৈতিক অবক্ষয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।
এর পরে আমি বলতে চাই, বিশ্বব্যাপী এ নৈতিক অবক্ষয়, ক্রুয়েলিটি, বার্বারিজম, টেররিজমের পেছনে রয়েছে মূলত দু’টি কারণ। অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমি বলব দু’টি কারণ বড়। একটি হচ্ছে সুশিক্ষা বা সত্যিকার শিক্ষার অভাব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে অসুস্থ সংস্কৃতি। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাপী এই যে অবস্থা, এ অরাজকতা, বর্বরতা, অমানবিকতা, এই যে অত্যাচার, জুলুম এর পেছনে রয়েছে মূলত দু’টি জিনিসÑ প্রকৃত ভালো শিক্ষার অভাব এবং অসুস্থ সংস্কৃতি। আমি সংস্কৃতির দিকে যাবো। কিন্তু শিক্ষা সম্পর্কে একটি কথা না বললে আমার কথা পূর্ণ হবে না। সুশিক্ষা কাকে বলে? প্রকৃত শিক্ষা কী? ইসলামের দৃষ্টিতে বা মানবতার দৃষ্টিতে ভালো শিক্ষা বা সুশিক্ষা কী? কোন শিক্ষা মানুষকে উন্নত করবে? আমি মনে করি, আমাদের এমন এক শিক্ষা লাগবে যাতে সম্পূর্ণ প্রফেশনালিজমও থাকতে হবে। অর্থাৎ এক দিকে থাকবে প্রফেশনালিজম, অন্য দিকে একটি মোরাল শিক্ষা তার লাগবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এ নৈতিক শিক্ষা ইসলাম দিতে পারে। আমি যে সুশিক্ষার কথা বললাম তার আন্দোলন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং চলছে। যার একটি উদাহরণ হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া। বাংলাদেশেও এ রকম ইসলামিক ইউনিভার্সিটি হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে নমুনা মাত্র। শিক্ষার এ আন্দোলনকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে। সারা বিশ্বে।
সংস্কৃতির দিকে আমি যখন তাকাই, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে সংস্কৃতি তার প্রজেকশনের যদি একটি ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে থাকে টিভিÑ তখন করুণ একটি চিত্র আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমার মনে হয় খুব খারাপ অবস্থা। আমি যখন সিনেমা দেখি, আমি খুব কমই দেখি, কিন্তু যতটুকু দেখি তাতে মনে হয়েছে সিনেমা হলো অশ্লীলতা ও যৌনতার নগ্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে বাণিজ্য করার একটি মাধ্যম। এটি তো হতে দেয়া যায় না। একই অবস্থা নাটকেও দেখা যায়। এমনকি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও দেখছি সে একই অবস্থা। একজন কবি আমাকে বলল যে, রবীন্দ্রনাথের যে উপন্যাস সে রকম উপন্যাস আজকে লেখা হচ্ছে না। নজরুল ইসলামের যে উপন্যাস সে রকম আজকে হচ্ছে না। সে মানবতাবাদ তাতে নেই, মানুষের কথা তাতে নেই, সে সুন্দর সমাজের কথা তাতে নেই। শরৎচন্দ্রের মতো উপন্যাস লেখা হচ্ছে না। এটি আমাদের ব্যর্থতা, সংস্কৃতির টোটাল ব্যর্থতা, সাহিত্যের টোটাল ব্যর্থতা। সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে আমার প্রশ্ন আজকে সে মানবতাবাদী নাটক, উপন্যাস কোথায়? সে দিকে আমাদের যেতে হবে।
মূল কথা হলো, অপসংস্কৃতি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যদি তা করতে হয় তাহলে আমাদের একটি সাউন্ড, সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যে চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের সামনে আসছে তার কয়েকটি রূপ আছে। একটি হচ্ছে তার পলিটিক্যাল রূপ। তার একটি ইকোনমিক চ্যালেঞ্জ আছে, একটি মিলিটারি চ্যালেঞ্জ আছে, একটি কালচারাল চ্যালেঞ্জও আছে। পাশ্চাত্য মূলত চাচ্ছে তাদের কালচার আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে। আমি একজন ইসলামিস্ট ও একজন মানবতাবাদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। একজন ইসলামিস্টের একটি বড় কাজ হচ্ছে মানবতাকে এ অশ্লীলতা থেকে উদ্ধার করা।
আমার মতে, আমাদের একটি সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য এ যে আন্দোলন, সে অন্দোলনকে সাহায্য করতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য কী? আমার মতে, সুস্থ সংস্কৃতির মূল উপাদান তিনটি। একটি হচ্ছে সুস্থ বিশ্বাস। মুসলমানদের ক্ষেত্রে, ইসলামের ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে তৌহিদ। দুই, অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। তিন, মানবতার বাণী তাতে থাকতে হবে, মানুষের কল্যাণের বাণী তাতে থাকতে হবে। মানুষকে সমৃদ্ধ করবে, মানুষের ুধা-দুঃখ দূর করবে, এমন একটি মেসেজ যে সংস্কৃতিতে থাকবে আমি সেটিকেই সুস্থ সংস্কৃতি মনে করব।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার