একজন বীর প্রতীকের উপহার

0
1053
blank
blank

ড. তুহিন মালিক: এক. বিজয় দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েও বঙ্গভবনে ঢুকতে দেয়া হয়নি একজন বীর প্রতীককে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ৩৫ বছর ধরে প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই এ দিনটিতে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। এমনকি কল্যাণ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেও গত আট বছরে যথারীতি বঙ্গভবনের দাওয়াতি হতে কখনো তাকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি, কিন্তু এবারের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় বঙ্গভবনের গেটে দণ্ডায়মান পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জানান, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের তালিকা অনুযায়ী, বঙ্গভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষিত ব্যক্তিদের মধ্যে তার নাম নাকি এক নাম্বারে রয়েছে। এর অর্থ, বঙ্গভবনের নিরাপত্তার জন্য তিনি নাম্বার ওয়ান হুমকি! একটি ছোট দলের প্রধানও যদি নাম্বার ওয়ান বিপজ্জনক হয়ে থাকেন, তাহলে বাকিরা তো দেখি মহাভয়াবহ! অথচ এই ঘটনায় স্বদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করা এই বীর প্রতীক কতটা লজ্জাবোধ করলে বলতে পারেন, ‘একজন বীর প্রতীকের জন্য বিজয় দিবসের উপহার। বিজয় দিবসে একজন বীর প্রতীককে অপমান করা কি জরুরি?’ প্রচণ্ড ক্ষোভে তিনি বলেন, ‘আমার তিনটি পরিচয়- প্রথমত, আমি একজন বীর প্রতীক। দ্বিতীয়ত, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তৃতীয়ত, আমি একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রধান। জানি না, এই তিন পরিচয় বা বৈশিষ্ট্যের কোনটিকে আক্রমণ করতে গিয়ে তারা কোনটিকে অপমান করল।’ আসলে জেনারেল ইবরাহিম তার তিনটি পরিচয়ের কথা বললেও চতুর্থ পরিচয়ের কথাটি কিন্তু বলেননি। তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান। আসলে সরকারের কাছে এটাই হচ্ছে তার বড় পরিচয়। আর এটাই তাদের কাছে বড় অপমানের, বড় যন্ত্রণার!

দুই. আসলে শুধু জেনারেল ইবরাহিম একাই নন, কি মুক্তিযোদ্ধা, কি বীর প্রতীক; ক্ষমতাসীন দল না করলে বাকি সবাই যেন আজ রাজাকার আর স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা বাণিজ্য চালায়, তাদের কাছে বীর প্রতীকের সম্মানহানি তো স্বেচ্ছাচারী আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ঠিক আছে, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কাউকে বঙ্গভবনে নিষিদ্ধ করলেন, কিন্তু দাওয়াত দিয়ে এভাবে অপমান করলেন কেন? জেনারেল ইবরাহিম দাবি করলেন, তার দলটি নিবন্ধিত। কিন্তু তিনি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন যে, শুধু নিবন্ধিত দল হলেই চলবে না, দাওয়াতটিও ‘নিবন্ধিত’ হতে হবে। একটা ভুল তিনি করেছেন বটে, আওয়ামী লীগের গুণকীর্তনে পারদর্শিতা অর্জন না করে তিনি বঙ্গভবনে গেলেনই বা কেন? অথচ বঙ্গভবনের সেই সংবর্ধনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের সুবিধা ভোগ করা লোকজনের কমতি ছিল না বলে জানা গেছে। বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় ছিলেন অনেক মুখচেনা লোক, যাদের ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়। তাই একজন বীর প্রতীককে ঢুকতে না দিয়ে বিজয়ের উৎসবটি কী গৌরবগাথার জন্ম দিলো তা বোধগম্য নয়। আমরা চাইলেও তো এখন আর নতুন করে কোনো বীর প্রতীকের জন্ম দিতে পারব না। যে দু-একজন বীরযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন, তাদেরকে এভাবে অসম্মান করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার নামান্তর নয় কি? বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রস্তুত করে আমন্ত্রণ করার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। কিন্তু এই তালিকায় কখনোই থাকে না কৃষকের কোনো ক্যাটাগরি। আমন্ত্রণপত্র পৌঁছায় না কোনো কৃষকের ঘরে। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনকারী, যুদ্ধাহত এবং যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই ছিলেন কৃষক পরিবারের। কৃষকের আত্মত্যাগে যে স্বাধীনতা, তার বিজয় উৎসবে কৃষকের কোনো জায়গা হয় না কেন?
তিন. গত পরশু বিজয় দিবসের একই সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসার সামনে স্ত্রী-সন্তানদের সাথে নিয়ে অনশন পালন করেছেন যুদ্ধাহত সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করায় প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে গত ১৬ আগস্ট ফরিদপুরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। এর আগে পুলিশ কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার নিয়ে তাই বিজয় দিবসে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন পালন করলেন। আসলে শুধু সরকারের ও দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন বলে বহু অভিযোগ রয়েছে। স্বয়ং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত এসব মন্ত্রী-নেতার তালিকা তুলে ধরেছেন। কিন্তু শুধু বিশেষ দল করার সুবাদে তারাই আজ কিনা বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। এদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হতে হচ্ছে নিগৃহীত। সচিবের হাতে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিতে হচ্ছে এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। অথচ দলীয় আশীর্বাদের কারণে মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান ও হত্যার বিচার হয় না। আওয়ামী ঘরানার নিষ্ঠাবান সাংবাদিক প্রবীর সিকদার আজ আওয়ামী নেতাদের রোষানলে পড়ে চরম জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত মহাবিপদ থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন।
চার. এখন অবস্থা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যে কেউ আওয়ামী লীগের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে, তাকেই রাজাকারের খেতাব দিয়ে দেয়া হবে। সাথে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম তো আছেই। অথচ তাদেরই বিগত শাসনামলের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি অব: এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে পর্যন্ত রাজাকার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ থেকেই। এমনকি সত্য ইতিহাস তুলে ধরার অপরাধে তাকে কুলাঙ্গার এবং আইএসআইয়ের এজেন্ট বলেও গালাগাল করেছেন নেতারা। দেউলিয়া রাজনীতির তাণ্ডব থেকে নিষ্কৃতি পাননি বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কেরা পর্যন্ত। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যাকে বীর উত্তম খেতাব দিলেন, সেই জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত কী করে আইএসআইয়ের এজেন্ট বলা যেতে পারে? নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও নিজের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া জিয়াকে যারা আজ পাকিস্তানের চর বলে তিরস্কার করছে, তাদের অনেকে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশই নেননি। মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে তারা পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় সুরক্ষিত ছিলেন। কেউ আবার কলকাতায় বসে নিশ্চিন্ত বিলাসী জীবনে মগ্ন ছিলেন। তবে আমাদের জাতীয় নেতারাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ঠিকই চরম আত্মত্যাগের মহিমায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। স্বীকার করতে হবে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানেই আমরা হানাদারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক দলের অর্জন হতে পারে না। দেশের সাধারণ মানুষ সেদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও নেতা মেনেই আমরা সবাই দলমত নির্বিশেষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি-উপসেনাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আর স্বাধীনতার ঘোষকের কি অবদান নেই? বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ায় যুদ্ধ করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনের অনেকেসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা সেদিন যুদ্ধে যাননি কেন, সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর দেয়া প্রয়োজন।
পাঁচ. মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যেদিন ইন্তেকাল করেন, সেদিন বঙ্গভবনে ছুটে গিয়েছিলেন সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সমাজের সব স্তরের সাধারণ মানুষ। চলমান সঙ্ঘাতময় রাজনীতির ভিড় ঠেলে রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একাত্মতা সেদিন দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ও তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে অভূতপূর্ব সহমর্র্মিতা প্রদর্শন করেছিলেন, তা সমসাময়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল ঘটনা। মরহুম রাষ্ট্রপতির সম্মানে সেদিন তিনি শুধু হরতাল প্রত্যাহারই করেননি, বরং বগুড়া ও জয়পুরহাটের সফরও স্থগিত করেছিলেন। বিএনপি অফিসে সেদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী কোনো প্রটোকল, অভ্যর্থনা বা সৌজন্যকে বাহানা না করেই ছুটে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। নিত্যদিনের সরকারি দলনপীড়নে আক্রান্ত মির্জা ফখরুলসহ দলের নেতারা এক কাতারবন্দী হয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির জানাজার নামাজে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জনপ্রিয় তবু তার বঙ্গভবনের দুয়ার একজন বীর প্রতীকের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো কেন, কার ইঙ্গিতে? এটা নিশ্চয়ই পূর্বপরিকল্পিত কিছু ছিল না। কারণ, পূর্বপরিকল্পিত হলে জেনারেল ইবরাহিমকে দাওয়াতই দেয়া হতো না। সরকারের মধ্যে অতি উৎসাহী কোনো অপশক্তির ইশারায় এহেন ন্যক্কারজনক ঘটনা কোনোভাবেই সরকারের জন্য লাভজনক হয়েছে বলে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। আসলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান জাতীয় ঐক্য গড়তে না পারলেও জাতির জন্য অনেক বড় প্রত্যাশার জন্ম দিতে পারে নিঃসন্দেহে। কি সরকারি দল, কি বিরোধী দল, দলমত নির্বিশেষে সব দলের রঙধনুতেই গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য লুক্কায়িত। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেন পরস্পর শত্রুতে পরিণত হবেন? আমাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সব দলের পারস্পরিক সহাবস্থান কবে নিশ্চিত হবে? এই তো ক’দিন আগে ভারতে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাড়িতে চায়ের আমন্ত্রণে গেলেন। আর আমরা একদল আরেক দলকে চিরতরে নির্মূল করার শপথ নিয়েই যেন রাজনীতি করছি।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

E-mail : drtuhinmalik@hotmail.com