কেন এই ছাত্ররাজনীতি?

0
1030
blank
blank

অধ্যক্ষ শিব্বির আহমদ ওসমানী: কিশোর ছাত্র হাবিবুর রহমান হাবিব কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে। সে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে সিলেটের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তে ভর্তি হয়। নিয়তির খেলায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে খূন হয় সে। তার খূনের মাধ্যমে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে কুলষিত করা হয়। কুলষিত করা হয় আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির এক দীর্ঘ ইতিহাসকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ সহ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক আগে সেই ১৯৫২ তে যে ছাত্ররাজনীতি এই ভূখন্ডে শুরু হয়েছিলো এবং এদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে যে ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো সেই ছাত্র রাজনীতি এখন কুলষিত দলীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তিতে।

সম্প্রতি দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষার্থী জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার অজুহাতে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন তথা ছাত্র রাজনীতি চালু করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা লেখা-পড়ার পরিবেশের জন্য অশনিসংকেত বলেই প্রতীয়মান হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষাবিদেরাও এই ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে সেখানেও সংঘাত, হানাহনি ‍ও খুনাখুনি ছড়িয়ে পড়বে এবং শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মূখীন হবে। আমাদের দেশের অনেক সাধরণ অভিভাবক রয়েছেন যারা পাবলিক বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদেরকে ভর্তি করাতে আগ্রহী হন না, শুধুমাত্র অসুস্থ ও সংঘাতময় রাজনীতির কবলে পরে আপনজনকে হাড়ানোর ভয়ে। তারা চান না হাবিবের মা-বাবার মত তাদের আপনজনকে হারাতে।

সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের ধরণা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতির কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি তৈরি হচ্ছে বলে যে বিবৃতি দিয়েছে তা পুরো সত্য নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যেমন জঙ্গিবাদে যুক্ত হচ্ছে না, তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও এই সংক্রমণ হতে মুক্ত বলা যাবে না। অসুস্থ ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাঙ্গনকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, শিক্ষাঙ্গনকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত করছে। গত এক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির প্রায় ৯০টি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া কিংবা নয়জন নিহত হওয়ার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।

আনুষ্ঠানিক ছাত্ররাজনীতি না থাকা সত্ত্বেও সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘাতে হাবিব নামের শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়েছে। চট্টগ্রামের আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে সংঘাত-সংঘর্ষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমান বাস্তবতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু করা হবে আত্মঘাতী। এই একটি ক্ষেত্রে আপনারা ছাড় দিন, ছাত্ররানীতির মতো একটি বিষবৃক্ষকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা না করে সুষ্ঠু পড়াশুনার পরিবেশ তৈরি করতে এগিয়ে আসুন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সবাই শিক্ষাঙ্গনে জঙ্গিবাদের অবসান চান। কিন্তু অসুস্থ ও সংঘাতময় ছাত্ররাজনীতি দিয়ে সেটি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য সরকার, শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের একযোগে কাজ করতে হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি যদি সত্যিই ছাত্রসমাজের কল্যাণ ও উন্নয়ন চায়, তাদের উচিত হবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি সামনে নিয়ে আসা। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে সামরিক শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক শাসনামলে তা বন্ধ হয়ে আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির দুষ্টক্ষত না ছড়িয়ে সরকারি-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিতে হবে। এবং ছাত্রসমাজকে সুস্থ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। ই-মেইল: sahmedosmani@gmail.com