গণতন্ত্রের প্রধান শর্তই হল অংশগ্রহণ: মার্কিন রাষ্ট্রদূত

0
514
blank
Marsia Barnicut
blank
ঢাকা: মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, গণতন্ত্রের প্রধান শর্তই হল অংশগ্রহণ। কোন রাজনৈতিক দল হলে তাকে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে। নাগরিক হলে তাকে ভোট দিতে হবে। বাংলাদেশ ও আমেরিকার নাগরিকরা ভাগ্যবান এই অর্থে যে, আমরা গণতন্ত্রের মধ্যে বাস করি। গণতন্ত্র শুধু অংশহ গ্রহণের মধ্যে কাজ করে। দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপ আহবানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রকৃতপক্ষে সতর্কতার সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছি না। আমরা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক স্পেস উন্মুক্ত করার আহ্বান জানাই। এক বছর আগে আমরা সহিংসতার ব্যাপারে শংকার কথা বলেছিলাম। রাজনীতিতে সহিংসতার কোন স্থান নেই। তাই আমাদের ফোকাস গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আবদ্ধ আছে। দলগুলোকে একসঙ্গে এসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। গণতন্ত্রের প্রধান শর্তই হল অংশগ্রহণ। কোন রাজনৈতিক দল হলে তাকে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে। নাগরিক হলে তাকে ভোট দিতে হবে। বাংলাদেশ ও আমেরিকার নাগরিকরা ভাগ্যবান এই অর্থে যে, আমরা গণতন্ত্রের মধ্যে বাস করি। গণতন্ত্র শুধু অংশগ্রহণের মধ্যে কাজ করে। দ্বিতীয় কথা হল, প্রক্রিয়াকে অবশ্যই সহিংসতামুক্ত হতে হবে। গত বছরের তুলনায় এ বছর পরিস্থিতি অনেক শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সহিংসতা ছাড়াই যাতে জনগণ তাদের নাম প্রার্থী হিসেবে দিতে পারে, প্রচার করতে পারে, নির্বাচনের দিনে ভোট দিতে পারে- এটিও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতিটি পদক্ষেপ-তা নির্বাচন হোক কিংবা সমাবেশ করাই হোক- প্রতি ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সুযোগ সৃষ্টি করে। গণতন্ত্রে জনগণ হল বস। জনগণই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচনে প্রার্থী নিবন্ধনের সুযোগ দিতে জনগণকে দাবি তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য জনগণকে সোচ্চার হতে হবে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বার্নিকাট বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সাংবাদিকের প্রকাশ করার অধিকার থাকতে হবে। তবে সাংবাদিকের এটিও দায়িত্ব যে, যেটা প্রকাশ করা হচ্ছে সেটা অবশ্যই যথার্থ হতে হবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশ সম্পর্কে, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে এবং আমাদের সরকারগুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেন সাংবাদিকরা। এটি আমাদের অনেক ভালো অবস্থায় রাখে। এটি আমাদের অনেক শক্তিশালী করে। এটি যাদের কোনো কণ্ঠ নেই তাদের বাকস্বাধীনতা দেয়, ন্যায়বিচারকে সামনে তুলে ধরে এবং আমার মতো নেতাদের জবাবদিহি করে। প্রেসিডেন্ট ওবামার এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সর্বদা আরও মানোন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হল সবচেয়ে বাজে ধরনের মানবাধিকার লংঘন। আমাদের আদালত ব্যবস্থা আছে, পুলিশ আছে, নাগরিকের জন্য নিশ্চয়তার স্থান আছে। কিন্তু আমি এটিও বলব যে, পুলিশ কিংবা অন্য কোনো আইনশৃংখলা বাহিনীর জন্য নিয়ম-কানুন আছে যা তাদের মেনে চলতে হয়। কোন ঘটনা ঘটলে পুলিশ গুলি কিংবা পাল্টা গুলি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে কেউ নিহত হলে সেই হত্যার পর্যালোচনা করা হয়। ওই হত্যাকা- ভুল ছিল কিনা সেই প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হতে হবে। এতে করে জনগণ বুঝতে পারে যে, ওই ব্যক্তির নিহত হওয়ার পেছনে আর কোন বিকল্প ছিল না। এ প্রক্রিয়াটি এখানেও চালু করা যেতে পারে। পুলিশ যদি ভালো চর্চা করে তবে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টি হবে।
বার্নিকাটের কাছে প্রশ্ন ছিল- বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিক থেকে কিছু সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
জবাবে তিনি বলেন, প্রথমে আমি ওইসব সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শোক প্রকাশ করছি। এসব হামলা যারা করেছে তারা জঘন্য অপরাধী। এ নিয়ে আমাদের দুই দেশের সরকারের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে আমরা অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাচ্ছি। জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিসহ আরও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ঘটনা বাংলাদেশের জাতীয় চরিত্রের প্রকাশ নয়। গত পাঁচ মাসে দশটি ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। আমাদের উভয় দেশই এটি স্বীকার করে যে, আইএস আমাদের দুই দেশের জন্যই হুমকি। আইএস সন্ত্রাসীরা কোন দেশে তাদের অফিস চালু করতে আসছে না। তারা ইন্টারনেট, প্রকাশনা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের জঙ্গি আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা এ বিশ্লেষণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে শেয়ার করেছি। আমেরিকায় সম্প্রতি সবচেয়ে বড় যে হামলার ঘটনাটি ঘটেছে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া একজন এবং তার স্ত্রী ওই হামলা করেছে, যারা এক শিশুকে রেখে এ কাজ করেছে। ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থানকে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে সামরিক বাহিনীর জন্য। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে, আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে এবং পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবির জন্য আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে। নতুন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠনে আমরা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছি। আমরা সোয়াদ টিম ও বোম্ব স্কোয়ার্ডকে প্রশিক্ষণ দেই। আমরা ব্রিটেন, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার লক্ষ্যে কাজ করছি। সন্ত্রাসের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে আমরা স্বাগত জানাই। জাতিসংঘের বিগত সাধারণ অধিবেশনে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই, সীমানা নেই। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাস দমন কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন। এ কারণে আমি এ ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারিত্বকে খুবই ভালো বলে মনে করি।
জিএসপি’র বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়টি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের হাতে। এ ক্ষেত্রে সত্যিকার মূল বিষয় হল শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা। শ্রমিকদের অধিকার দেয়ার নিশ্চয়তার আগ্রহ থাকতে হবে। এ সংস্কারের লক্ষ্যে জিএসপি পুনর্বহালে আমরা কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। এগুলোর সবই বাংলাদেশ আইএলও’র সঙ্গে অঙ্গীকার করেছে। আরেকটি বিষয় হল, পোশাক শিল্প খুবই প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছে। ৩০ বছর আগে যে অবস্থা ছিল এখন সে অবস্থা নেই। এখন নতুন প্রতিযোগী দেশ হিসেবে এসেছে ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ইথিওপিয়া ও কেনিয়া। এখন তাই আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করতে হবে। এটিই হল এ শিল্পের কাছ থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। সুসংবাদ হল, এই মান বৃদ্ধি পেলে শিল্পের মালিকদের ও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। ২০১৫ সালে ৭২ ভাগ ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ সরকার। ইপিজেডের জন্য নতুন আইনের যে খসড়া সেখানেও সংশোধনের প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশে সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?-এমন প্রশ্নে-
বার্নিকাট বলেন, জিএসপি একটি আইনগত ইস্যু। আমাদের কংগ্রেস জিএসপি প্রথা সৃষ্টি করে কিছু সুস্পষ্ট নিয়ম-কানুন করে দিয়েছে। কোন দেশকে জিএসপি থেকে লাভবান হতে হলে এ ক্রাইটেরিয়া অবশ্যই পূরণ করতে হবে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জিএসপি স্থগিত করার পর বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি ঘটিয়েছে। ফলে জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়টি ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশের হাতেই রয়েছে। এটি ফিরে পাওয়ার জন্য অ্যাকশন প্ল্যান রয়েছে। এর আওতায় মূল বিষয়ই হল শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়ার সদিচ্ছা। এ অধিকার হতে হবে আইএলও’র সমান মানসম্পন্ন। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে হলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পোশাক শিল্পে সংস্কার হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কেননা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত হলে তাদের অনুপস্থিতির হার কমে যায়। দেখা গেছে, একটি কারখানায় অনুপস্থিতির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে গেছে। ছুটির দিনেও শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী হয়েছেন। এতে করে শিল্পটি পুরো উৎপাদন করতে পেরেছে। এ সময়ে কারখানায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়া কম হয়েছে। ফলে কারখানায় ১০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে কারখানার মালিক অর্থ সাশ্রয় করতে পেরেছেন। ফলে সুসংবাদ হল, এ সংস্কার কার্যক্রমের ফলে শ্রমিকের সুরক্ষা হচ্ছে, কারখানার সুরক্ষা হচ্ছে এবং কারখানার মালিক মুনাফা পাচ্ছেন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
১৯৭১ সালে যুদ্ধে বাংলাদেশে যারা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে, তাদের বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক, এ বিচারে কোন ব্যক্তির দায়-দায়িত্বের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু বিচার কামনা করে। এ বিচারে মৃত্যুদ- থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে, ন্যায়বিচার যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। সেটি অবশ্যই সন্তোষজনক আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।