ঘরের আগুনে পুড়ছে জাতীয় পার্টি

0
694
blank
blank

ছলিম উল্লাহ মেজবাহ: জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) ফের পুড়ছে ঘরের আগুনে। পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে সহোদর জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর মাত্র ১৮ ঘণ্টা পর সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হলো। গতকাল শনিবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সাংগঠনিক নির্দেশনায় এ অব্যাহতির কথা জানান এরশাদ।

এই সময় তিনি তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে মনোনিত করেন। এর মধ্য দিয়ে জাপায় সেই পুরানো গৃহবিবাদ আবারো শুরু হয়েছে। দলটির একাধিক নেতারা মনে করেন আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পার্টির মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনতে পারেন এরশাদ। মসিউর রহমান রাঙ্গার সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে আবারো এ পদে বসানো হতে পারে সাবেক মহাসাচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে। এদিকে জিএম কাদের ও মসিউর রহমান রাঙ্গা দেখা করতে গেলেও এরশাদের দেখা পাননি। জানা গেছে, শুক্রবার মধ্যরাতে আরেক সাংগঠনিক নির্দেশনায় জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেন এরশাদ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে কোনো ধরনের সুনিদিষ্ট কারণ ছাড়াই মহাসচিবের পদ থেকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে জাপায় শুরু হয় অস্থিরতা। এই অস্থিরতার নতুন মাত্রাপায় শুক্রবার মধ্যরাতের একটি প্রেসরিলিজকে কেন্দ্র করে। ঐ রাতে জাতীয় পার্টির বনানীর অফিস থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংগঠনিক নির্দেশ নামে যে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়, সেখানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলে জানানো হয়। সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো জানানো হয়, ইতিপূর্বে এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন। এরশাদের অবর্তমানে পার্টির সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা প্রদান জি এম কাদেরকে। কিন্তু জিএম কাদের তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রেস রিলিজে জানান জাপা চেয়ারম্যান।

সেই কারণে দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এরশাদ। হঠাৎ করে এই প্রেস রিলিজ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানলের স্কল ও বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে শুক্রবার মধ্য রাত থেকে দেশে বিদেশে অবস্থানরত জাতীয় পার্টির অনেকেই প্রথমে এই প্রেস রিলিজকে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। অনেকেই আবারো এই প্রেস রিলিজকে সত্য উল্লেখ করে এর জন্য দলের অনেক নেতাকে দায়ি করেছেন।

অপরদিক কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে গোলাম মোহাম্মদ কাদের শুক্রবার রাতে বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ বৃহস্পতিবার রাতে আমাকে এরশাদ সাহেব বলেছিলন, তুমি (জি এম কাদের )খুব ভালো করছ। আমি (এরশাদ) তো আর বেশি দিন বাঁচব না, তুমি দলটাকে বাঁচিয়ে রেখ। আমি জানি তা তুমি পারবে। তবে গতকাল শনিবার বিকেলে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানানো জন্য জিএম কাদেরকে একাধিক ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। জাপার একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, শুক্রবারের প্রেস রিলিজে এরশাদ স্বাক্ষর করেছেন। এ ছাড়া শনিবার সকালে প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করেও ভাই এরশাদের সাক্ষাৎ পাননি জিএম কাদের। এই সময় জিএম কাদেরের সঙ্গে মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে এরশাদের সাক্ষাৎ না পেয়ে অনেকটা নিরাশ হয়ে ফিরে যান।

অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধীদলের আভ্যন্তরীণ সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক ও মিডিয়া পাড়ায় আবারো আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা বিষয়টিকে এরশাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আবারো অনেকেই বলেছেন, এই বিষয়ে মন্তব্য করাও সময় নষ্টের সামিল।

জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ থেকেই জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা এক প্রকার লেজেগোবরে হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের কয়েকজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাজিণ্যের অভিযোগ ওঠাকে কেন্দ্র করে জাপায় ছিল অস্থিরতা। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের দীর্ঘদিনের কাণ্ডারী হিসেবে পরিচিত মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিয়ে হুট করে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব মনোনিত করা। আপর জোটগত ভাবে নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আশানুরূপ আসন না পাওয়া, ৪৬ থেকে ২৪টি আসনে নেমে আসা, দলের মহাসচিব এবি এম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ দশম জাতীয় সংসদে এমপি হওয়া অনেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মনোনয়ন না পাওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেয়াসহ নানা কারণে নির্বাচনের পর থেকে দলের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এর মধ্যে গত ৭ জানুযারি দলের কো-চেয়ারম্যান নিজের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলের ভবিষ্যত চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করে সাংগঠনিক নির্দেশ প্রদান করেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

এরশাদের এই সিদ্ধান্তকে দলের তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকর্মী সমর্থন থাকলেও বেকে বসেন দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। তারা এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গার পাশাপাশি প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের বিরোধীতা শুরু করেন। কিন্তু পার্টির তৃণমূল রাঙ্গার বিপক্ষে থাকলেও ক্লিন ইমেজ ও এরশাদের ভাই হওয়ার কারণে জিএম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে গত দুই মাসের বেশি সময় দায়িত্ব থাকলেও রাঙ্গার পাশাপাশি জি এম কাদেরও দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে পারেনি বলে অভিয়োগ রয়েছে দলের নেতাদের।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, কে কোন পদে থাকবে সেটা এরশাদ সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কেন তাকে সরিয়ে দেয়া হলো সেটা এরশাদ সাহেবই ভালো জানেন। তবে তিনি জি এম কাদেরের সমালোচনা করে বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়। পার্টির কোনো নেতার সঙ্গে দেখা করবেন না, কথা বলবেন না, তাহলে রাজনীতি কীভাবে হয়। নির্বাচনের আগে বা পরে একবারও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসেননি তিনি।

[মানবকণ্ঠ]