তত্ত্বাবধায়ক না সহায়ক বিএনপিতেই দ্বিধা

0
501
blank

এনাম আবেদীন:

বিএনপি যে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে তার নাম ‘সহায়ক’, নাকি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার হবে—এ নিয়ে দলে এখনো ঐকমত্য আসেনি। বিএনপির নেতাকর্মীরা এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছে।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার টাঙ্গাইলের সন্তোষে দেওয়া এক বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপির দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী সহায়ক সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ’

এদিকে গতকালই ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনাসভায় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া যদি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে শেখ হাসিনা কেন পারবেন না। ’

মওদুদ আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে আমরা তাকে অভিনন্দন জানাব। ’ এর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যেও ‘আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে’ বলে জানিয়েছিলেন মওদুদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহায়ক সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার রূপরেখা মূলত লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মাথা থেকে বেরিয়েছে। লন্ডনে তিনি এটি আলোচনা করেন তাঁর মা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। খালেদা জিয়া গত ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরার পর ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তোলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি গত ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ের কথা উল্লেখ করেন।

অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বিচারপতি টি এইচ খানের বক্তব্য ওই রায়ে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বক্তব্যে বলা হয়েছে, ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর অবসরগ্রহণের পর স্বাক্ষর করেছেন। ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায় যথাযথভাবে হয়নি।
তবে বিএনপির ওই বৈঠকে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ই বিএনপির অবস্থান—সর্বসম্মত এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ এর পর থেকেই দলের একটি অংশ সহায়ক নয়, তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে মাঠে নেমে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। বিশেষ করে তারেক রহমানের আনুকূল্য পাওয়ার প্রত্যাশী নেতারাই এ ব্যাপারে আগ্রহী বেশি বলে জানা যায়।

কিন্তু দলের বড় একটি অংশ নতুন এ অবস্থানে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বলে জানা যায়। তাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর দলের সমর্থক প্রবীণ একজন বুদ্ধিজীবী অনেক গবেষণা করে ওই শব্দটি (সহায়ক) বের করেন। শব্দটি এরই মধ্যে জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া দুই বছর ধরে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে এর পক্ষে জনমত গঠন করেছে। খোদ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিজের বক্তব্যেই ‘সহায়ক’ শব্দটি বহুবার উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে, একই বছরের ১০ মে ‘ভিশন ২০৩০’ উপস্থাপনের সময় লিখিতভাবে এবং পরে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া দলটির লিখিত প্রস্তাবেও সহায়ক সরকারের প্রস্তাব যথাসময়ে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন হঠাৎ করে সহায়ক বাদ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দাবি করা হলে জনগণের মধ্যেও ভুল বার্তা যাবে বলে বিএনপির ওই অংশ মনে করছে। পাশাপাশি সরকারও নতুন করে এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে বলে তারা আশঙ্কা করছে। তাদের অনেকে এও বলছেন, মূল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ারও আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ওই রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত না করার কথা উল্লেখ ছিল।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, সমস্যাটি বড় কিছু না। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির প্রস্তাবের নামকরণ নির্বাচনকালীন সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সহায়ক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা-ই হোক—রূপরেখা একই। ফলে নামে কিছু এসে যায় না। তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবেন বলেছেন। কিন্তু এর পরিবর্তন হয়েছে বলে শুনিনি। ’

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সরকার সহায়ক বা প্রয়োজন, সেটিই সহায়ক সরকার। বিএনপি সেই সহায়ক সরকারেই আছে। তিনি বলেন, রূপরেখা যেহেতু এখনো চূড়ান্ত হয়নি, ফলে বিভিন্ন মহল থেকে পরামর্শ আসতেই পারে। এটি দোষের কিছু নয়।

তবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা দুই দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে—এমন প্রত্যাশা থেকে সহায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকারপক্ষ বারবারই বলে যাচ্ছে নির্বাচন প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই হবে। সহায়ক শব্দটি এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ফলে কৌশল পরিবর্তন করে আমাদেরও এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলতে হচ্ছে। ’

২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়; যদিও এর আগে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়ে আরো দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যায় এমন পর্যবেক্ষণ ছিল। কিন্তু ১৬ মাস পরে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে ওই বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।