তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ, কী লাভ কী ক্ষতি

0
731
blank
stu
blank

এস এম আববাস: প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চলতি বছর থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ব্যবস্থার সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। এর পাশাপাশি জোরদার মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকা আবশ্যক। এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারলে ভালো ফল বয়ে আনবে বলে আশাবাদী শিক্ষাবিদরা।
সরকারের এই পদক্ষেপকে সঠিক বিবেচনা করা হলেও শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করবে শিক্ষক ও মনিটরিং ব্যবস্থার ওপর। শিক্ষকদের প্রস্তুত করা এবং মনিটরিংয়ের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এই পদ্ধতি ভালো ফল বয়ে আনবে না। মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে শুধু তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নয়, মাধ্যমিক স্তরেও ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করা গেলে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরের সব ক্লাসেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি শেষে রয়েছে পাবলিক পরীক্ষা। এতে নির্দিষ্ট নম্বরের ভিত্তিতে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল দেওয়া হয়। যদিও পৃথিবীর উন্নত সব দেশেই প্রাথমিক স্তরের কোনও ক্লাসে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা নেই। ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমেই লেখাপড়া করানো হয়।
উন্নত দেশের মতো মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সৃজনশীল ও কর্মমুখী লেখাপড়া শেখানোর জন্য নতুন এই ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে সরকার। শিশুদের চাপমুক্ত রেখে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন থেকে ধারাবাহিক ক্লাস মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করা হবে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুসারে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নতুন এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ যতীন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের ওপর ভীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ভর্তির জন্য যে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তা অবৈজ্ঞানিক। শিশুদের আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী প্রচলিত ব্যবস্থা। পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চললে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। এসব বিবেচনা করলে এই পদক্ষেপ ভালোই হয়েছে।’
নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে মূল্যায়নের যে বিষয়টি বলা হয়েছে— সেটি কীভাবে করা হবে তা আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বেশি। এর সাফল্য নির্ভর করছে শিক্ষকরা সঠিকভাবে ক্লাস নেবেন কিনা, প্রতিদিনের পাঠদান শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে পারলো কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখার ওপর। ষান্মাসিক ও বার্ষিক রিপোর্টের ব্যবস্থা যদি থাকে তাহলে নতুন সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে। আর এটা যদি না করা যায়, তাহলে এখন যা আছে তার চেয়ে ভালো কিছু হবে বলে আমি মনে করি না।’
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভালো। “তোতাপাখির মতো মুখস্ত করো, যাহা জানো তাহা লিখ” এসব দিয়ে মেধাশক্তি জাগানো যায় না। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নটা কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত। আমি মনে করি, বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটা সভা হওয়া উচিত। মূল্যায়নের লিখিত অংশ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি না হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা কোনও একটি বই পড়বে, সে সম্পর্কে বলবে– এভাবে সেগুলোর মূল্যায়ন হবে। ধরা যাক, জীবজন্তু নিয়ে সুন্দর একটি বিষয় বের করে দেওয়া হলো। শিশুরা সেটি সম্পর্কে লিখবে, জানবে। নিউজিল্যান্ড ও নরওয়েসহ উন্নত দেশগুলোতে এরকমই করা হয়।’
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না দেওয়া শিশুদের জন্য হঠাৎ করে চতুর্থ শ্রেণিতে পরীক্ষা কঠিন হবে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘না কঠিন হবে না। শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর লেখালেখি তো বন্ধ থাকবে না। তাই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নিলেও সমস্যা হবে না। তিন বছর একটি শিশু স্বস্তি নিয়ে পড়লে তার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে হঠাৎ করে বড় পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। তা নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় ভিন্নতা আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় পরীক্ষা নেওয়া হয় তবে তা ভিন্নরকম। পরীক্ষার জন্য বাছাই করা বিষয় নিয়ে প্রস্তুতি নিতে বলা হয় শিক্ষার্থীদের। তারপর পরীক্ষা নেওয়া হয়।’ উদাহরণ দিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের হয়তো দুটো রচনা দিয়ে বলা হলো, পড়ে আসতে। তারা প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। তারপর পরীক্ষা নেওয়া হবে।’
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন রয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়ন থাকবে, কিন্তু বর্তমানে যেসব পরীক্ষা নেওয়া হয় তা শিশুদের জন্য থাকা উচিত নয়। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির আগে কোনও পাবলিক পরীক্ষা রাখার দরকার নেই। পরীক্ষার কারণে শিশুদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হয়।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে তার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ধারাবাহিক মূল্যায়ন পুরোটা নির্ভর করবে শিক্ষকদের ওপর। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের ধারাবাহিক মূল্যায়নমুখী করতে হবে। তা না হলে ফল ভালো হবে না।’
উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা
ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের প্রতিটি দেশেই তিন থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত সরকারিভাবে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করানো হয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তিন বছর বয়সেই, শেষ হয় পাঁচ বছরে। এই তিন বছর বয়সে শিশুদের নিয়ে খেলাধুলার পাশাপাশি পশু-পাখিসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের বিভিন্ন বিষয় চেনানো হয়। রংসহ শিশুদের পরিবেশের আকর্ষণীয় বিষয়গুলো চেনানো হয়। শেষ বছরে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া হয়। পরীক্ষা নেই। সবই চলে ধারাবাহিক মূল্যায়নে। আর গাদা গাদা বই-পুস্তকের বাহারও নেই।
ছয় বছর থেকে শুরু হয় মূল প্রাথমিক শিক্ষা। ছয় বছরে বাক্য তৈরি থেকে শুরু করে বিপরীত শব্দ কী তা শেখানো হয়। ব্যাকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ের ধারণা দেওয়া হয় প্রথম বছর। আর এগুলো চলে শিশুদের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে। এ পর্যায়ে পরীক্ষার বদলে থাকে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আট থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বিদেশি ভাষা শেখানোয় যুক্ত করা হয়। ১১ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কলেজ এডুকেশন বলা হলেও মূলত এটি মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া। ১৪ বছর শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। ১৫ বছর থেকে শুরু হয় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া, শেষ হয় ১৮ বছরে। ছুটির সময় ছাড়া বাড়ি থেকে বই নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। গণিতসহ কঠিন বিষষের হোমওয়ার্ক থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হোমওয়ার্ক প্রয়োজন হয় না। ক্লাসেই লেখাপড়া সম্পন্ন হয়। পরীক্ষার কাজটিও শেষ হয় ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। ফলাফল নিয়ে শিশু কিংবা অভিভাবকদের কোনও চাপ সামলাতে হয় না।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাতেও প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষা ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাব্যবস্থায় ইউরোপের চেয়ে ভিন্নতর হলেও মানের দিক থেকে প্রায় একই রকম। এসব দেশেও শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উত্তীর্ণ করা হয়। পাবলিক পরীক্ষা প্রাথমিকের শেষ পর্যায়ে। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নত বলে ধরা হয়। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক স্তর শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। এখানে ক্লাস পরীক্ষা বা শিশুদের নম্বরভিত্তিক গ্রেডিং নিয়ে কোনও চাপ নেই।

[বাংলা ট্রিবিউন]