নির্বাচন পর্যন্ত আ.লীগের তৃণমূলে বহিষ্কার ও কমিটি বাতিল নয়

0
594
blank
blank

ডেস্ক রিপোর্ট: নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার ও কমিটি বিলুপ্ত করা থেকে বিরত থাকার জন্য জেলা, উপজেলা, মহানগর ও পৌর কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘দলের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে’ চলার নীতি থেকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খুব বড় কোনো অঘটন না ঘটলে এখন থেকে কাউকে বহিষ্কার বা কোনো কমিটি বিলুপ্তি করার পথে হাঁটবে না দলটি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বুধবার দলের প্রতিটি জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের চিঠি দিয়ে বহিষ্কার ও কমিটি বিলুপ্তি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে গত সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া অনেক নেতাকে কেন্দ্রীয়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁদের সবাইকে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাধারণ ক্ষমা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থেই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলে ব্যাপক বিভক্তি তৈরি হয়েছে। এই বিভক্তি থেকে বিভিন্ন এলাকায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে আছে। সেটা মিটিয়ে দলের মাঠপর্যায়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন করে যাতে বিভক্তি তৈরি না হয়, সে জন্যই এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নতুন এই নির্দেশনার ফলে জেলা, মহানগর ও উপজেলা কমিটি কাউকে সাময়িক বহিষ্কারের অধিকারও হারাল। সব সিদ্ধান্ত কেন্দ্র থেকে নেওয়া হবে। অবশ্য আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, দলের যেকোনো নেতাকে বহিষ্কারের এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের। কমিটি বাতিলের ক্ষমতাও কেন্দ্রের। তবে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কাউকে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করার ক্ষমতা তৃণমূলের আছে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটিরই।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, তৃণমূল পর্যায়ে জেলা, মহানগর এমনকি উপজেলা নেতারাও এত দিন তাঁদের অধীনে থাকা শাখা সংগঠনের নেতাদের বহিষ্কার করেছেন হরহামেশাই। কখনো কখনো পুরো কমিটি বিলুপ্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভেদের জের হিসেবে এটা করা হতো। টাকার বিনিময়ে কাউকে পদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার প্রবণতা রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
জেলা ও উপজেলায় দলের নেতৃত্বে সাংসদেরা, সেসব স্থানে নিজেদের ‘পকেট’ কমিটি করার জন্য তাঁরা অপছন্দের নেতাকে বহিষ্কারের আশ্রয় নেন—এমন অভিযোগও বিভিন্ন সময় উঠেছিল। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বেশির ভাগ সময় এসব দেখেও না দেখার ভান করত বলে দলীয় সূত্রগুলো বলছে।
হঠাৎ করে তৃণমূলের কমিটিকে এমন নির্দেশনার কারণ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা গঠনতন্ত্রেই আছে। কিন্তু কেউ কেউ এটা অমান্য করার চেষ্টা করে থাকে। এখন সামনে নির্বাচন, তাই দলে ঐক্য জরুরি। সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি বা ছোটখাটো কোন্দলও ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনে যাওয়াই এখন দলের মূল লক্ষ্য।
জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌরসভা নেতাদের কেন্দ্রের চিঠি। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঐক্যের চেষ্টা:
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বড় কোনো অপরাধ না করলে নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় কমিটিও বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্তে যাবে না। সংশ্লিষ্ট নেতাদের ডেকে এনে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে। অপরাধ বিবেচনা করে সতর্ক ও তিরস্কার করা হবে। প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয়ভাবে বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু দল থেকে বের করে দেওয়া হবে না।
সম্প্রতি খুলনার পাইকগাছায় বিরোধপূর্ণ ৫০ শতক জমির দখল নিতে আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়ির চারপাশে উঁচু দেয়াল তুলে তাঁর পুরো পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন দলীয় সাংসদ নূরুল হক। গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আসার পর বুধবার ওই সাংসদকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে ডেকে এনে সতর্ক করে দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাংসদের দুই ছেলেকেও ভর্ৎসনা করেন ওবায়দুল কাদের। পরে সংক্ষুব্ধ পরিবারটির কাছে সাংসদ দুঃখ প্রকাশ করেন এবং নিজেদের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার আশ্বাস দেন। ওই দেয়ালও ভেঙে ফেলা হয়।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, খুন, জখম কিংবা ফৌজদারি বড় অপরাধের বেলায় কেন্দ্রীয়ভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সিরাজগঞ্জে সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল হত্যায় অভিযুক্ত শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক ও সদস্য কে এম নাসিরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারী শিক্ষার্থীদের অনুরোধে পিঠে চড়ার কারণে বহিষ্কৃত হন। এই দুই ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আসার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বুধবার দলের সাধারণ সম্পাদকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমতি ছাড়া কোনো ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, থানা, উপজেলা ও জেলা শাখার কমিটি বিলুপ্ত করা যাবে না। অথচ আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে ইতিমধ্যে কোনো কোনো জেলা তাদের অধীন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌর, থানা, উপজেলা ও জেলা কমিটি বিলুপ্ত করেছে। কোথাও কোথাও আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পরিপন্থী।’
চিঠিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে যদি কাউকে বহিষ্কার করার প্রয়োজন হয়, তাহলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠাতে হবে। কাউকে বহিষ্কার করার এখতিয়ার একমাত্র কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের।
চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দলের উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কোথাও কোথাও বহিষ্কার ও কমিটি বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য তৃণমূলের নেতৃত্বকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় শক্তি, সামর্থ্য ও সংহতির সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্যই সর্বস্তরে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।