পুঁজিবাদের অমানবিকতা ও ইসলামি অর্থনীতি

0
1063
blank
blank

শাহ্ আব্দুল হান্নান: পুঁজিবাদ বিশ্বের সর্বাধিক চালু অর্থনীতি। ফরাসি বিপ্লবের আগে ও পরে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের নেতাদের হাতে এর বিকাশ হয়। তারা ছিলেন মূলত নাস্তিক। ফলে পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ সেকুলার ও অনৈতিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। এরই ফলে পুঁজিবাদের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি অমানবিক ও সুবিচারবিরোধী তত্ত্ব বা থিওরি।

প্রথমত, তারা বলে যে অর্থনৈতিক আইন হচ্ছে প্রাকৃতিক আইনের মতো (Economic laws are like natural laws)। সুতরাং অর্থনীতিকে নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। বাজারব্যবস্থায় বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এর অর্থ হচ্ছে অবিচার বন্ধ করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ত, তারা বলে যে মানুষ পুঁজিবাদী প্রাণী, সে আর্থিক স্বার্থ (Pecuniary in treat) ছাড়া কোনো কাজ করে না। এ তত্ত্ব মানুষকে অমানুষ বানায়। এর অর্থ হচ্ছে এ কথা বলা যে, মানুষকে নিঃস্বার্থ কাজ করার কথা বলা অর্থহীন।
তৃতীয়ত, তারা বলে যে অর্থনীতিকেও ডারউইনের তত্ত্ব ‘যোগ্যরাই টিকবে’ (Survival of the fittest) এ ভিত্তি মেনে চলতে হবে। একে বলে সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism)। অর্থাৎ অযোগ্যরা টিকবে না। তাতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। এটাই প্রাকৃতিক আইন। এরই ফলে অসংখ্য ছোট ফার্ম ধ্বংস হয়ে সারা বিশ্বের ৯০ শতাংশ সম্পদ ১০০ করপোরেশনের হাতে চলে গেছে। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং এ কাজে সুদ পুঁজিবাদকে সাহায্য করেছে। সুদের প্রকৃতিই হচ্ছে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ।
চতুর্থত, পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরা বলেন যে, অর্থনীতি একটি পজিটিভ বিজ্ঞান (Positive Science)। এখানে মূল্যবোধ থাকার কোনো সুযোগ নেই। মূল্যবোধ টেনে আনলে অর্থনীতি স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলবে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ হচ্ছে মূল্যবোধহীন অর্থনীতির প্রবক্তা।
পুঁজিবাদের ফলে গত ২০০ বছর কী হয়েছে? এক দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু দেশ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো লুট করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশীয় পুঁজিবাদ দেশের জনগণকে শোষণ করেছে। পুঁজিবাদ দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। জনগণের মধ্যে বৈষম্য ভয়াবহ। এমনকি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সব সম্পদ কিছু ধনীর হাতে, যেমন করপোরেশনগুলো, ব্যাংক, শেয়ারের মালিক। সাধারণ নাগরিকেরা বেতন দিয়ে জীবন ধারণ করে, তাদের বলতে গেলে সঞ্চয় নেই। ক্রেডিট কার্ডে চলে। বেকারও অনেক। তাদের অবস্থা কাহিল।
পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের অদক্ষতা ও নীতিহীনতার জন্য (তারাও তত্ত্বে নাস্তিক, সেকুলার) যেহেতু ধনীরাই রাষ্ট্র ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারে না।
বিশ্বে বর্তমানে একমাত্র ইসলামই একটি নীতিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তা। ইসলামে বিশ্বাসী লোকেরাই ইসলামি অর্থনীতি ও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর সাহিত্য তৈরি করেছে। কিছু সুদহীন ব্যাংক চালু করেছে। অন্য কোনো ধর্ম তা করেনি। ইসলামি অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা, আল্লাহতে বিশ্বাস, মানুষকে আল্লাহর খলিফা মনে করা এবং সর্বোপরি সুবিচারে বিশ্বাস।
ইসলামি অর্থনীতিতে বাজার থাকবে, তবে তা নিরঙ্কুশ (absolute) হবে না। সরকার সেখানে সুবিচারের প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে। একে ইসলামে হিসবা (Supervision) বলা হয়। ইসলামি অর্থনীতিতে মনোপলি ভেঙে ফেলা হবে, প্রয়োজনে জাতীয়করণ করা হবে, প্রয়োজনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে, লাভ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, হারাম পণ্য উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হবে, ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হবে।
তেমনিভাবে রাজস্ব নীতিতে (fiscal policy) ব্যাপক পরিবর্তন করা হবে, বিশেষ করে ব্যয় নীতিতে (expenditure policy)। সরকার যদি চায় তবে বিচার সহজ করার জন্য কোর্ট ফি তুলে দিতে পারে (যেমন মুসলিম আমলে ছিল) এবং সেটি চালানোর খরচ সরকার তার রাজস্ব থেকে বহন করবে (যেমন প্রাইমারি শিক্ষার ক্ষেত্রে করা হয়)। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিচারালয়ে যাওয়া সহজ হবে। তেমনিভাবে মুসলিম আমলের মতো যারা পারে না তাদেরকে উকিলের মাধ্যম ছাড়া কোর্টে সরাসরি দরখাস্ত করার এবং বিচার চাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
মুদ্রানীতিতে (Monetary policy) বর্তমানের চেয়ে আরো ভালো করা সম্ভব। ড. উমর চাপড়া তার Towards a Just Monetary policy শীর্ষক লেখায় বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে টাকা ছাপে (যাতে খরচ অতি সামান্য) তা সরকারকে বিনা সুদে দিতে হবে (জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য) এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দিতে হবে মুদারাবার ভিত্তিতে (লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্ব পদ্ধতিতে)। এ টাকা যেহেতু ‘ফাও’ টাকার মতো, তাই লাভ কম হলেও বা না হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। তেমনিভাবে তিনি বলেন যে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে টাকা বানায় (অর্থাৎ ব্যাংক যেভাবে deposit creation-এর মাধ্যমে জমা টাকাকে কয়েক গুণ বানিয়ে ফেলে) তার মালিকানা জনগণের ধরতে হবে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক সে টাকা ব্যবহার করে যে লাভ করবে তার অংশ (ধরুন লাভের ৬০ শতাংশ) সরকারি ট্রেজারিতে জমা দিতে হবে। অর্থাৎ জনগণকে দেয়া হবে।
ইসলামি অর্থনীতিতে সব সেক্টরই গুণগতভাবে পরিবর্তিত হবে (ব্যাংকব্যবস্থা, স্টক মার্কেট, ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা)। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে যাবে, দারিদ্র্য দূর হবে, জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান হবে। অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য জাকাতের পরিবর্তে অন্য রাজস্ব ব্যবহার করা হবে।
সর্বশেষে বলতে চাই পুঁজিবাদের অমানবিকতার সমাধান সবখানে, অন্তত মুসলিম বিশ্বে ইসলামি অর্থনীতি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমি ড. উমর চাপড়ার ‘ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ এবং ‘অর্থনীতির ভবিষ্যৎ’ বই দু’টি পড়ার অনুরোধ করছি। (BIIT উত্তরা প্রকাশিত, ফোন ৫৮৯৫৪২৫৬, ৫৮৯৫৭৫০৯১
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার