বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী আজ

0
546
blank
blank

ডেস্ক রিপোর্ট: বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী আজ। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের দিন। সেদিনের ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্তত তিন শ’। নৃশংস এ ঘটনার এখনো ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে অনেকেই অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

২১ আগস্ট হত্যা মামলার বিচার চলছে। ইতোমধ্যে ২২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে বলে জানা যায়। ২১ আগস্টের মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতা, পুলিশের সাবেক তিন আইজিসহ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, বিভিন্ন সংস্থার সাবেক শীর্ষ সারির কর্মকর্তা এবং জঙ্গিসংগঠনের সদস্যসহ মোট ৫২ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। এদের মধ্যে ২২ জনের বিরুদ্ধে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চার্জশিট প্রদান করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধিকতর তদন্তে বাকি ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই মাসে। এ দিকে বিএনপি এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের নেতাদের এ মামলায় আসামি করেছে।
যা ঘটেছিল সেদিন : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে এদিন গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ২৪ জন নিহত এবং অন্তত তিন শ’ জন আহত হন। ঘটনার পরদিন দণ্ডবিধি এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রথমে এ মামলাটির তদন্ত করেন মতিঝিল থানার এসআই আমির হোসেন। পরে মামলাটি ডিবি পুলিশে স্থানান্তর হলে মামলার তদন্ত করেন ডিবির ইন্সপেক্টর মো: শামসুল ইসলাম। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হয়। সিআইডিতে স্থানান্তরের পর মামলার তদন্তের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এএসপি আব্দুর রশিদ এবং মুন্সি আতিকের ওপর। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্ত করেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবির। তিনি ২০০৮ সালের ১১ জুন ওই মামলায় ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে মামলা দু’টির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষে সিআইডির এসএস আব্দুল কাহহার আখন্দ ২০১১ সালের জুলাই মাসে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করেন। ইতঃপূর্বে এ ঘটনায় মুফতি হান্নানসহ আট হরকাতুল জিহাদ সদস্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। আদালতে দাখিলকৃত সরকারের আবেদনে গ্রেনেডের উৎস্য এবং এ ঘটনার নেপথ্যে কারা রয়েছে তা জানার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এর আগে সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবিরের দেয়া চার্জশিটে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, তার ভাই মাওলানা মফিজুর রহমান ওরফে অভি, পিন্টুর ছোট ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আবু তাহের, শরীফ শাহিদুল ইসলাম ওরফে বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর, মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল, আবুল কালাম বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, আনিসুল মুরসালিন ওরফে সুজন, তার ভাই মহিবুল মুক্তাকিন ওরফে শাহীন, হোসাইন আহম্মেদ ওরফে তামিম, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, ইকবাল, মাওলানা আবু বকর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, রফিকুল ইসলাম গাজী ওরফে শফিক ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে সবুজ ওরফে রতন, উজ্জ্বল ওরফে রতন, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে জাহাঙ্গীর বদর ও মাওলানা খলিলুর রহমান ওরফে খলিলকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ফজলুল কবিরের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও আরো ছয়জনের জড়িত থাকার ব্যাপারে তথ্য ছিল। তাদের মধ্যে দু’জন মারা যাওয়ায় এবং বাকি চারজনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকায় চার্জশিট থেকে তাদেরকে বাদ দেয়া হয়। ওই সময় মুরসালিন এবং মুক্তাকিন ভারতের কারাগারে বন্দী ছিলেন।
২০১১ সালের ৩ জুলাই এই মামলায় আদালতে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করে। এর মধ্যে বিএনপির সহসভাপতি তারেক রহমান, বিএনপির সহসভাপতি শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আব্দুর রহিম, হারিছ চৌধুরী, হানিফ পরিবহনের মালিক মো: হানিফ, ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুর রহমান, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (আইডিপি) আহবায়ক মাওলানা আব্দুস সালাম, আব্দুল মজিদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই রাতুল বাবু ওরফে বাবুল, পুলিশের সাবেক আইজি শহুদুল হক, আশরাফুল হুদা এবং খোদা বক্স, ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, এসপি ওবায়দুর রহমান, সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আব্দুর রশিদ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব:) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এবং মেজর জেনারেল (অব:) এ টি এম আমিন রয়েছেন। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ইতোমধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
চার্জশিট প্রদানের আগে থেকেই আসামিদের অনেকেই জেলহাজতে রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা এ মামলায় জেল খেটেছেন এবং এখনো অনেকে জেলে রয়েছেন।
চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানসহ মামলার ১৯ জনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে ২৬ জন কারাগারে আটক এবং সাবেক তিনজন আইজিপিসহ আটজন জামিনে রয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে জামিনপ্রাপ্তরা হলেন, সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা, শহীদুল হক এবং খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডির সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশীদ জামিনে আছেন।
গত বছর ২১ আগস্ট পর্যন্ত এ মামলায় ১৭৬ জনের স্যা নেয়া সমাপ্ত হয়েছিল। চলতি বছরের এ সময়ে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে ২২৪ জনের। এক বছরে এটুকুই মামলার অগ্রগতি হয়েছে। মামলার পিপি আবু আব্দুল্লাহ ভূঞা বলেছেন, ৪৫১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। তিনি বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি ফজলুল কবিরের জেরা চলছে বর্তমানে। এ দিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গতকাল বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
বাসস জানায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ তার বাণীতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন, গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার পাশাপাশি পরমতসহিষ্ণুতা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে সব রাজনৈতিক দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতন্ত্রকামী জনগণ একটি আত্মমর্যাদাশীল ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসবেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি কালোদিবস। ২০০৪ সালের এদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসভায় বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় শহীদ হন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। শোকাবহ ওই মর্মান্তিক ঘটনায় সব শহীদের স্মৃতির প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রুখে দেয়া এবং দেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা; কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ তা হতে দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও হতে দেবে না। রাষ্ট্রপতি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে ২১ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে দেশের সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২১ আগস্টের হামলাকারী, পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা এবং তাদের মদদদাতাদের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে। আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট উপলে দেয়া বাণীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্টকে একটি কলঙ্কময় দিন হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ২০০৪ সালের এই দিনে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী সমাবেশে বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
তিনি বলেন, তখন চার দিকে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হচ্ছে। এর মধ্যেও আমাদের নেতাকর্মীরা মানববর্ম সৃষ্টি করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নয়নের ধারাকে স্তব্ধ করে দেয়া। বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে হত্যা, ষড়যন্ত্র, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে চিরস্থায়ী করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা।
এ ধরনের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচার করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হলেও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার করার বদলে তাদের রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, তারা অনেক আলামত ধ্বংস করে। তদন্তের নামে এই নারকীয় ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। জনগণকে ধোঁকা দিতে জজ মিয়া নাটক সাজায়; কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে বিএনপি-জামায়াত জোটের অনেক কুশীলব এই হামলার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল।