বিএনপির সিনিয়ররা হতাশা ও অস্বস্তিতে

0
562
blank

ওয়ালি উল্লাহ: একদিকে প্রায় ২১ মাস ধরে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে, অন্যদিকে তার অনুপস্থিতিতে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় তারা। বিশেষ করে বিএনপির যেসব সিনিয়র নেতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন অস্বস্তিবোধ তারাই বেশি করছেন। তারা বেগম জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে স্বস্তিবোধ করলেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রাজনীতিতে এক ধরনের দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। নানা কারণে তারা লন্ডনে নির্বাসিত থাকা তারেক রহমানের নেতৃত্ব মন থেকে মানতে পারছেন না। এদিকে আবার তারেক রহমানের নেতৃত্ব পছন্দ বিএনপির তরুণ নেতাদের। তারা তারেক রহমানকে আগামী দিনে দলের প্রধান ও রাষ্ট্রনায়ক মনে করছেন।

এরই মধ্যে বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করেন দলের প্রভাবশালী নেতা ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, মোরশেদ খান ও সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। তাদের পথ ধরে আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতাও দল ছাড়তে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়।
জানা যায়, পরপর দলের সিনিয়র দুই নেতার পদত্যাগ করায় বিএনপিতে হতাশা আর অস্বস্তি বাড়ছে। তোলপাড় শুরু হয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে। প্রভাবশালী আরও কয়েকজন নেতার পদত্যাগের আশঙ্কাও করছে বিএনপি। পদত্যাগী নেতাদের ধরে রাখতে দলের হাইকমান্ডও নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে দুই নেতার পদত্যাগপত্র এখনো গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দী দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে রাজপথের বড় কোনো কর্মসূচি না থাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও ক্ষুব্ধ। বেগম জিয়ার মুক্তিতে প্রেস ক্লাবে মানববন্ধনে বিরক্ত সিনিয়র নেতাদের অনেকেই। প্রায় ৭৪ ঊর্ধ্ব বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারের টনক নড়ানোর মতো কোনো কর্মসূচি দিতে না পারায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সমালোচনায় মুখর মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়াকে ঘিরে তারেক রহমানের সঙ্গে সিনিয়র নেতাদের দূরত্ব বাড়ে। নির্বাচনের পর দলের পাঁচ এমপির শপথ নিয়েও বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। পাঁচ এমপির শপথের বিষয়টি জানত না বিএনপির স্থায়ী কমিটিও। তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে যান। পরে অবশ্য সিনিয়র নেতারা বিষয়টি মুখ বুজে মেনে নেন। এদিকে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা ও দলের অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন পুরোটাই দেখভাল করছেন তারেক রহমান। দলের সিনিয়র নেতারাও এ বিষয়টি জানেন না। এখন কোন্দল আর দলাদলিতে আটকে আছে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা পর্যায়ের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। ১৯টি জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিতে না পারায় তৃণমূল নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হাইকমান্ড।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের কারণ হিসেবে জানা যায়, লন্ডনে এক সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার বাবা জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দেন। এর সমর্থনে নেতা-কর্মীদের কাছে প্রস্তাবও পাঠান। সভায় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা তারেক রহমানের প্রস্তাবকে কণ্ঠভোটে সমর্থন করেন। পরে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এলে দ্বিমত প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মাহবুবুর রহমান। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে চারজন নেতা মাহবুবুর রহমানের দ্বিমত হওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয়, মাহবুবুর রহমান যেন তার দ্বিমতের বক্তব্যের বিষয়ে লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। দুই দিন পর এ বিষয়ে জানতে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য মাহবুবুর রহমানের বাসায় গেলে তিনি তার দ্বিমত পোষণের বক্তব্যে অনড় থাকার কথা জানিয়ে দেন। এরপরই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

বিএনপির সিনিয়র নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তিনবার জেলে গিয়েছি। প্রত্যেকবার রাজপথ থেকে গিয়েছি, আমারে বাসা থেকে ধরে নাই কখনো। একটা লোক ফোন করে খবর নেয় নাই। এই দলের কর্মীরা অনেক সাহসী, নেতারা দুর্বল। নেতাদের কেউ কেউ এত পয়সা বানিয়েছে যে, রাজপথে রোদ লাগাতে ইচ্ছা করে না। আমরা তো বানাই নাই। ছয়বার এমপি হয়েছি আমার তো বাড়ি নাই। বাবার দেওয়া বাড়িতে থাকি। আমার বিরুদ্ধে তো কোনো দুর্নীতির মামলাও নাই।’

বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। দলের আপাদস্তক এই রাজনীতিবিদ এখনো দলের ভাইস চেয়ারম্যান। বিএনপির রাজনীতিতে তার ত্যাগও কম নয়। তার বয়সে অনেক ছোট বা তারই কর্মী স্থান পেয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে। অনেকটা অভিমান করেই তিনি জানান, ‘বিএনপি শহীদ জিয়ার গড়া জাতীয়তাবাদী আদর্শের একটি দল। সেই দলের একজন কর্মী হিসেবেই আমি গর্বিত। পদ-পদবি কোনো বিষয় নয়।’

পদত্যাগী নেতাদের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তারা চলে যাক। তাদের নিয়ে আমাদের সময় কাটানোর দরকার নেই। কিন্তু আমরা যারা আছি, তাদের মধ্যে কোনো মোনাফিকের ভাব আছে কিনা, আমরা সঠিকভাবে রাজপথে নামতে চাই কিনা, আগে তা দেখে আন্দোলনের ডাক দিন। খালেদা জিয়ার মুক্তি হবেই।

[সূত্র: আমাদেরসময়]