বিএনপি জোটে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দেনদরবার শুরু

0
515
blank

এনাম আবেদীন: বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শরিকরা প্রত্যাশা অনুযায়ী এবার খুব বেশি আসনে ‘ছাড়’ পাবে না। কারণ আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন নেওয়ার মতো প্রার্থী বেশির ভাগ দলেরই নেই। মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে জোটে দেনদরবার শুরু হয়ে গেছে।

বিএনপি ও জোটভুক্ত দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে ৩৫টি আসনে ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। দলটির সঙ্গে ‘সমঝোতা’ হলেও এবার আর অত আসন ছাড়তে হবে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিবন্ধন স্থগিত থাকায় দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারবে না জামায়াত। তবে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী দিতে পারবে দলটি। আর সমঝোতা হলে ‘স্বতন্ত্র’ ওই প্রার্থীকে সমর্থন দেবে বিএনপি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় মতিউর রহমান নিজামীর পাবনা-১, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফরিদপুর-৩ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের শেরপুর-১ আসনে জামায়াতকে আর ছাড় দিতে হবে না বলে মনে করে বিএনপি। অন্যদিকে একই মামলায় মাওলানা আবদুস সোবহান ও এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ায় পাবনা-৫ ও রংপুর-২ এখন বিএনপির জন্য উন্মুক্ত। পাশাপাশি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হওয়ায় জটিলতা কমেছে পিরোজপুর-১ আসনটি নিয়েও। এ আসনে অবশ্য সাঈদীর ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে জয় নিশ্চিত বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। তবে ওই আসন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারকেও ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।

সূত্র মতে, জাতীয় পার্টির এ অংশের নেতাদের মধ্যে মনোনয়ন আলোচনায় নাম রয়েছে কুমিল্লা-১১ আসনে প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের মেয়ে জয়া কাজী, মৌলভীবাজার-২ আসনে নওয়াব আলী আব্বাস এবং সাতক্ষীরা-৪ আসনে এ এইচ এম গোলাম রেজার। কুমিল্লা-১১ ও সাতক্ষীরা-২ আসন ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে দেওয়া হয়েছিল।

সূত্র মতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী কক্সবাজার-২ আসনে জামায়াতের এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ ও চট্টগ্রাম-১৪ আসনে আ ন ম শামসুল ইসলামকে এবার বিএনপি ছাড় দিতে পারে। এ ছাড়া ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে যাঁরা দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন এমন কয়েকজনকেও ছাড় দেওয়ার চিন্তা আছে। তবে এ সংখ্যা কোনোক্রমেই ৮-১০ জনের বেশি হবে না। ২০০৮ সালের ফলাফলে জামায়াত দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল এমন ৩২টি আসনের মধ্যে আছে ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর-১ ও ৬, নীলফামারী-২ ও ৩, লালমনিরহাট-১, রংপুর-১ ও ২, গাইবান্ধা-১, ৩ ও ৪, সিরাজগঞ্জ-৪, পাবনা-১ ও ৫, চুয়াডাঙ্গা-২, ঝিনাইদহ-৩, যশোর-১ ও ২, বাগেরহাট-৩ ও ৪, খুলনা-৫ ও ৬,সাতক্ষীরা-২, ৩ ও ৪, পিরোজপুর-১, শেরপুর-১, সিলেট-৫ ও ৬, কুমিল্লা-১১, কক্সবাজার-২ ও চট্টগ্রাম-১৪।

বাকি ১৮ দলকে ১০ থেকে ১২টি আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। দলটির নেতাদের মতে, এর মধ্যে এগিয়ে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। এরপরে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি সর্বোচ্চ দুটি, বিজেপি দুটি, জাগপা একটি, জমিয়তে ওলামা ইসলাম একটি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) একটি ও মুসলিম লীগ একটি আসনে ছাড় পেতে পারে। বাকি বেশির ভাগ দলের নিবন্ধন নেই, নেতাদের আসনও নেই।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১৩ আসনে অলি আহমদের নিজের, কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের এবং লক্ষ্মীপুর-১ আসনে এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। এ ছাড়া প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল করিম আব্বাসীর জন্য নেত্রকোনা-১, আবদুল গণির জন্য মেহেরপুর-২ ও আবু ইউসুফ খলিলুর রহমানের জন্য জয়পুরহাট-২ আসনে মনোনয়ন চাইবে এলডিপি। তবে এগুলোতে ছাড় নিশ্চিত নয়।

আবদুল করিম আব্বাসী বিএনপির তিনবারের সংসদ সদস্য হলেও নেত্রকোনা-১ আসনে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁকেই প্রার্থী করা হয়েছিল। ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে আব্বাসীকে মনোনয়ন দেওয়া কঠিন বলে অনেকে মনে করে।

জয়পুরহাট-২ ও মেহেরপুর-২ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন যথাক্রমে গোলাম মোস্তফা ও আমজাদ হোসেন। ফলে তাঁদেরও বঞ্চিত করা কঠিন। তবে অলি, রেদোয়ান ও সেলিমের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে আছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তিসহ নির্দিষ্ট কিছু আসনে ছাড় দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রস্তাব দেওয়া হয় এলডিপিকে। খালেদা জিয়া এ খবর পেয়ে ওই তিন নেতার সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন যখনই হোক, তাঁদের মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বলে জানা যায়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে এলডিপি। একইভাবে ২০১২ সালে ১৮ দলীয় জোট গঠনের সময়ই কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী; আগের চট্টগ্রাম-৪) আসনে মনোনয়ন চান। সেখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তাঁরই মামা হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, যিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে হেরে যান। তাঁর মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা কিছুদিন আগে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে বেশ কয়েক মাস কারাগারে ছিলেন। মনোনয়নের কথা উঠলে কেউ কেউ তাঁর নামও বলে। একই আসনে মনোনয়ন চান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর নাসিরউদ্দিন এবং তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলালও। সব মিলিয়ে এ আসনটি বেশ ঝামেলাপূর্ণ বিএনপির কাছে। এর বাইরে কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমানের জন্য পাবনা-১ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ইকবাল হাসান মাহমুদের জন্য নারায়ণগঞ্জ-২ আসন চাইবে দলটি।

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘আমাদের চাওয়া অনেক থাকবে। কারণ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটের জন্ম হয়েছে। তবে বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখেই আসন বণ্টন হবে বলে আশা রাখি। ’

বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ভোলা-১ এবং জমিয়তে ওলামা ইসলামের চেয়ারম্যান মুফতি মোহম্মদ ওয়াক্কাস যশোর-৫ আসন থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন, এটি নিশ্চিত। পৈতৃক আসন ভোলার পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর যেকোনো একটি আসন থেকেও পার্থর নির্বাচন করার আগ্রহ আছে। টক শোর পাশাপাশি নবম সংসদে বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসা পার্থর ঢাকায় তরুণসমাজের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে বলে অনেকে মনে করে।

আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এটিও সবার মনে রাখতে হবে, এর জন্য একটি নির্বাচনী আসন থাকা দরকার এবং জয়লাভের ন্যূনতম সম্ভাবনাও থাকা চাই। অর্থাৎ প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সমন্বয় করে আসন বণ্টনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ’

দিনাজপুর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত ছিল জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের। সম্প্রতি তিনি মারা যান। তবে প্রধানের অবদানের কারণে তাঁর স্ত্রী রেহানা প্রধানকে ওই আসন ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা আছে বিএনপির।

এঁদের বাইরে মনোনয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নাম আলোচনায় আছে। গানি নীলফামারী-১ এবং কামরুজ্জামান কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে মনোনয়ন চাইছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনেম খাঁর ছেলে কামরুজ্জামানকে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। ওই আসনে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মজিবুর রহমান মঞ্জু কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।

কামরুজ্জামান বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা না হলেও নিবন্ধিত দল হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করি। আশা করি, বিএনপি চেয়ারপারসন বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। ’

নীলফামারী-১ আসনে এখন চোখে পড়ার মতো কোনো নেতা নেই বিএনপিতে। খালেদা জিয়ার বোনের ছেলে শাহরিন ইসলাম তুহিন এ আসনে দুইবার নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁর বাবা রফিকুল ইসলাম বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। সে হিসেবে বিএনপির সাবেক এমপি ও মন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপনের ছেলে গানির প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

জেবেল রহমান গানি বলেন, ‘দল হিসেবে নিবন্ধন রক্ষার স্বার্থে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। ফলে জোট নেত্রী আমাকে ছাড় দেবেন বলে আশা করছি। ’

তাঁদের বাইরে বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান পিরোজপুর-২ আসন থেকে মনোনয়ন চাইছেন। ওই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, যিনি ৫৯ হাজার ১১৬ ভোটে আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ শাহ আলমের কাছে পরাজিত হন। বর্তমানে মঞ্জুর অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় ওই আসনে মনোনয়ন চাইছেন তাঁর ছেলে ভাণ্ডারিয়া উপজেলা সভাপতি হাসান মঞ্জুর সুমন। যদিও কেন্দ্রে তাঁর পরিচিতি কম। সেই তুলনায় নিবন্ধন না থাকলেও ঢাকায় ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিতে তত্পরতা চালিয়ে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।

জানতে চাইলে ইরান বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে আছি। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুবিচার পাব বলে আশা করি। ’

সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা। কিন্তু তিনি মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিশ্চিত নয়।

আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও আসন বণ্টন প্রশ্নে ২০ দলে তত্পরতা শুরু হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। তবে এ বিষয়ে জোট শরিকদের মধ্যে উৎসাহ রয়েছে। সময় হলে গত তিনটি নির্বাচনের ফল, উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি নেতাদের আসনভিত্তিক সম্ভাবনা যাচাই করে মনোনয়ন দেওয়া হবে। পাশাপাশি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোকেও যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। ’

সূত্র: কালের কণ্ঠ