বিজয় দিবসের প্রত্যাশা : গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

0
796
blank
blank

সৈয়দ আবদাল আহমদ:

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।

বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর।
রাত পোহালেই আলো ঝলমল করে উদ্ভাসিত হবে আমাদের
বিজয়ের আনন্দের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১’
কবিতায় লিখেছিলেন-
‘পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনটি
টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায়
ভরে গিয়েছিল আমাদের শহর।’

একাত্তর থেকে ৪৬ বছর পর কালকের ১৬ ডিসেম্বরেও আমরা দেখতে পাবো টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায় ছেয়ে গেছে আমাদের দেশটা। আমরা গলা ছেড়ে গাইব কবি শামসুর রাহমানের ‘বিজয় দিবস’ এর ছড়া গান-
‘কোকিল, দোয়েল গান গেয়ে বলে,
আজ আমাদের বিজয় দিবস।
গোলাপ, বকুল বলে এক সাথে
আজ আমাদের বিজয় দিবস।’

সত্যিই এই বিজয়ের কোনো তুলনা নেই। না, আমাদের তুলনাহীন এই বিজয় দিবস এমনি আসেনি। এই বিজয় রক্তে কেনা। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে এই বিজয় আমরা ছিনিয়ে এনেছি।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে বাঙালি জাতির ওপর শুরু হয়েছিল মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদের নারকীয় বর্বরতা; কিন্তু এই ঘোরতর অমানিশা ভেদ করে ৯ মাসের মাথায় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চির ভাস্বর সূর্য। পত পত করে উড়তে থাকে স্বাধীনতার পতাকা। এই পতাকা বিজয়ের পতাকা। নতুন দেশের উদয়ের সূর্য। স্বাধীন সূর্যোদয়। এই স্বাধীন দেশের নাম বাংলাদেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয়। আমরা সম্মিলিতভাবে গেয়ে উঠি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। তেমনি সবচেয়ে কষ্টের, যন্ত্রণারও। একই সাথে সবচেয়ে উজ্জ্বল, আনন্দের ঘটনাও। লাল-সবুজ পতাকা আমাদের মনে করিয়ে দেয় অগণিত শহীদের গর্বিত আত্মোৎসর্গের কথা। তাদের পবিত্র রক্তের মূল্যেই আমরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি রক্তসূর্য- প্রিয় স্বাধীনতা।
মায়ের রক্তার্জিত পতাকা চিরদিন বাংলার আকাশে উড়বে।
আগেই বলেছি ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় উদযাপনের দিনটি অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফল। বাঙালির হাজার বছরের জীবনে এমন বিজয় আর কখনো আসেনি। মহান বিজয়ের এই দিনে ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
আজ যে আমরা স্বাধীন, আজ যে আমরা বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত- এই বিজয় আমরা অর্জন করেছি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

একাত্তরের রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি নিয়ে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করতে গিয়ে সাহিত্যিক রশীদ হায়দার লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে, তখন পৃথিবীর যত ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রই ব্যবহার করা হোক না কেন, সেই আবেগের কাছে তা তুচ্ছ হয়ে যায়। তার প্রমাণ আছে আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধে। বিশ্ববাসী সেই প্রমাণ পুনরায় প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৭১ সালে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে।’ সত্যিই একাত্তরের স্বাধীনতার জন্য, বিজয়ের জন্য আমাদের প্রাণের আবেগ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই রক্ত ঝরাতে আমরা পিছপা হইনি। আর রক্ত দিয়েই আমরা লিখেছি বাংলাদেশের নাম। তাই বাংলাদেশের মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় একাত্তর, শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ আর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র। সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছি, দেশ পরিচালিত হবে ইনসাফ, গণতন্ত্র ও মানবিকতার আদর্শে। আজ বিজয়ের ৪৬ বছর পর আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে কী দেখতে পাই? আমরা কি পুরোপুরি স্বাধীন? আমরা কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। মানবিকতার চর্চা কি করতে পেরেছি? সহজ উত্তর হবে, আমরা পারিনি। স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সাবলীলভাবে আমরা উপভোগ করতে পারছি না। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল সত্য; কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রটির বিকাশে তারাই পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। তাদের চোখরাঙানি ও শোষণের শিকার হচ্ছি। আমাদের দেশ কিভাবে চলবে, আমাদের নির্বাচন কিভাবে হবে কিংবা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি কিভাবে চলবে আড়ালে-আবডালে তারাই কলকাঠি নাড়ে।

বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য; কিন্তু গণতান্ত্রিক আদর্শ ও রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ হাঁটছে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের পথে, ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্বপরায়ণতার পথে। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-এর একপেশে নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, সেই ধারাও অব্যাহত থাকেনি। সংসদীয় ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদল প্রতিষ্ঠা করা হয়। নস্যাৎ করা হয় গণতান্ত্রিক চেতনার। পরে বহুদলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্র পুনরায় চালু হলেও বেশি দিন তা অব্যাহত থাকেনি। সামরিক শাসন তাকে ব্যাহত করে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হয়। নানা রাজনৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও পরপর তিনটি নির্বাচন হয়; কিন্তু ২০০৬ সালে আবারো গণতন্ত্র হোঁচট খায়। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার প্রায় দুই বছর দেশ পরিচালনার পর নির্বাচন হয়। কিন্তু যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা সেই পঁচাত্তরের বাকশালের মূলমন্ত্রেরই বাস্তবায়ন ঘটায় সর্বত্র। পাঁচ বছর পর সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দিয়ে একটি একতরফা প্রহসনের আয়োজন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা ভোটের নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করে দেশে চালানো হয় স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন। এই কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনে দেশে জনগণের ভোটের অধিকার নেই।

গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে গেছে। সুশাসন শব্দটি দুঃশাসনে পরিণত হয়েছে। মৌলিক মানবাধিকার, বাক-ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কোথাও বিচার নেই। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা পুঁথির কথায় পরিণত হয়েছে। বিচারের বাণী আজ নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জেল-জুলুম নির্যাতনে কায়েম হয়েছে ত্রাসের রাজত্ব। এই রাজত্বে দুর্নীতিই সুনীতি। ব্যাংকিং খাতকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। সেখানে চলছে ‘লুটপাট’। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয়করণ পৌঁছেছে চরম অবস্থায়। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে আজ আর কিছু নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সঙ্কট ক্ষমতাসীনেরা সৃষ্টি করেছে, সে সঙ্কট নিরসন হতে পারে একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই। কিন্তু সে ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আরো বেশি আসন পাবে। এর অর্থ কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ ২০১৪ সালের সেই বিনাভোটের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে যাওয়া হবে, সেটিই ইঙ্গিত।
এখন থেকে এটাই স্পষ্ট, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এ দেশে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ন্যায়বিচার থেকে জনগণ বঞ্চিতই রয়ে গেছে। মানবিক রাষ্ট্র হওয়ার বদলে অমানবিকতা স্থান করে নিয়েছে এখানে। ফলে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।

তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু উন্নয়ন ঘটেছে। সামাজিক সূচকগুলোতে অর্জন আছে। সেখানে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যে বাংলাদেশে প্রায় স্বয়ংসম্ভরতা অর্জিত হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে উন্নতি ঘটেছে। দারিদ্র্য আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে গণতন্ত্র নেই, সুশাসন নেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। পরমত সহিষ্ণুতা এখানে অনুপস্থিত। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সঙ্কট উত্তরণের মানসিকতা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা এ বিষয়টিকে কোনো মূল্যই দিচ্ছে না। গণতন্ত্র ও সুশাসন থাকলে দেশ আরো অনেক দূর এগিয়ে যেত। আজ বাংলাদেশের ৪৭তম বিজয়ের দিনে আমাদের প্রত্যাশা হোক একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, একটি ন্যায়বিচারসম্পন্ন মানবিক বাংলাদেশের। আমরা চাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও জনস্বার্থবিরোধী শাসনের অবসান হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপ্ন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব