বিদেশে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে: প্রধানমন্ত্রীর

0
547
blank

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবাসায়ীদের বিদেশে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে তাকে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, দেশের রফতানি খাতকে সমৃদ্ধ করতেই এটি জরুরি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু একদিকে তাকালে চলবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নতুন দেশ, নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং সেইসব বাজারে কোন ধরনের পণ্য রফতানি করা যায় সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।’

একই সাথে উৎপাদিত পণ্যের মান নিশ্চিত করা, ব্রান্ডিং করা এবং এগুলোকে আকর্ষণীয় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা সাহায্য করার তা তার সরকার করে যাচ্ছে এবং করে যাবে বলেও উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা সোমবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার (ডিআইটিএফ) উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

সরকার প্রধান বলেন, সবসময় মাথায় রাখতে হবে বর্তমান বিশ্ব অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এই প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের বলেন শুধু নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনলেই হবে না। সাথে সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। আপনার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো একান্তভাবেই প্রয়োজন।

বহিঃবিশ্বে বর্তমান সরকারের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরো ১২ টি দেশে নতুন দূতাবাস এবং ১৭টি মিশন খোলা হয়েছে। সে সব দেশের অ্যাম্বাসেডর, হাইকমিশনারদের ডেকে ওয়ার্কশপ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং দেশে বিনিয়োগ কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরফলে ব্যবসার দ্বার আরো উন্মুক্ত হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ বছর ওষুধ শিল্পকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ও ঘোষণা করেন।

বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমপি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।

অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সুভাশীষ বোস এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বক্তৃতা করেন। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য স্বাগত বক্তৃতা করেন।

মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, কূটনিতিক, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং মেলায় অংশ গ্রহণকারী দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে দেশের বাণিজ্য খাতের অগ্রগতি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র ‘উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ প্রদর্শিত হয়।
দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ তাঁদের নতুন পণ্য প্রদর্শনীর সুযোগ পান। আবার দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদার একটি চিত্রও তাঁরা পেয়ে থাকেন। ফলে পণ্যের মানোন্নয়ন ও বহুমুখী করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি শিল্প-উৎপাদনের দিকে নজর দেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া কলকারখানাগুলো জাতীয়করণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্র শাসনের সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৭ ভাগের উপরে উঠে গিয়েছিল। অথচ ’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো সে সব কলকারখানা পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যস্ত পড়ে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে তার সরকার বেসরকারি খাতের উন্নয়নে কাজ শুরু করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়। তার সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল, সরকার নিজে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, কিন্তু সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। এই উদ্যোগের ফলেই আজ দেশে বেসরকারি খাত ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের ৪৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ। এখন আমদানি ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আয় থেকে মেটানো হচ্ছে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের মতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে একই সাথে উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রীতিমত বিস্ময় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স’ বলেছে ‘নেক্সট ইলেভেনে’র প্রথমে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০৫০ সালে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ‘সিটি ইনভেস্টমেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস’ বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত প্রবৃদ্ধির দিক থেকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশগুলোর তালিকায় প্রথমদিকে স্থান দিয়েছে। এভাবে আইএমএফ, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, জেপি মর্গনান চেজ, এবং মর্গান স্ট্যানলি বাংলাদেশকে অপার সম্ভবনাময় দেশগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে যুক্ত করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অত্যন্ত বড় অর্জন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ১৯৯টি দেশে ৭৫০টি পণ্য রফতানি করা হচ্ছে ২০১৬-২০১৭ সালে রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের অবস্থান আরও সুসংহত হবে।

আমাদের অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাভাবিকভাবেই একটা দেশকে উন্নয়ন করতে হলে শিল্পায়নে যেতে হবে। কিন্তু, কৃষিকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কৃষিটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, কৃষির মধ্যদিয়েই আমাদের খাদ্য নিরপত্তা নিশ্চিত হয়। অর্থনীতি ত্বরান্বিত করতে শিল্পয়নটাও করতে হবে। আবার রপ্তানিও করতে হবে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। যাতে আমরা স্বাধীরতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে পারি বাংলাদেশকে ক্ষুধা মুক্ত এবং দারিদ্র মুক্ত করে। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সমৃদ্ধ দেশ। সেভাবেই দেশকে আমরা গড়তে চাই।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার তাদের অর্থনৈতিক নীতিমালায় গ্রামকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। পণ্য ব্যবহারে গ্রামীণ জনগণের ক্ষমতাটা যেন বাড়ে, আপনাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে তারা যেন তাদের জীবন মান উন্নত করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, সেই সাথে আর একটা পদক্ষেপ আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ। আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে একটি সুসম্পর্ক রেখে তাদের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো।

প্রধানমন্ত্রী আইসিটি খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, দেশে এখন আট কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে এবং ১৬ কোটি মানুষের দেশে মোবাইল ফোনের ১৩ কোটি সিম সংযোগ রয়েছে।

তিনি এ সময় দেশে মোবাইল ফোন সংযোজনকে উৎসাহিত করে বলেন, এসব পণ্যতো আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারি। এখন দেশে কিছু কিছু অ্যাসেম্বিলিং হচ্ছে। এটাকে আরো আমরা গুরুত্ব দিতে পারি। প্রধানমন্ত্রী আইসিটি খাতের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার আহবান জানান।

সারাদেশে একশ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলায় তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে এই অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে যাতে, বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে দেশে ব্যবহার এবং বিদেশে রপ্তানী করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে মামলা করে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা অর্জনের প্রসংগ তুলে ধরে বলেন, বিশাল যে সমুদ্র এলাকা আমরা অর্জন করেছি তার সম্পদকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এই সম্পদও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সবক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারে।

চামড়া খাতের উন্নয়নে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে আমরা চামড়া খাতকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিলাম। সেইসাথে চামড়া শিল্পের উন্নয়নে আমরা ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছি।

এ বছর ওষুধ শিল্পকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প একটি উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প। দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ যোগান দিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অষ্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকাসহ শতাধিক দেশে ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ওষুধ শিল্পের উন্নতির লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জে এ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করেছি।

ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান এবং নতুন বছর সবার জন্য আরো উন্নতি এবং প্রগতি নিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

পরে প্রধানমন্ত্রী বণিজ্য মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।