ঢাকা : শেষ দিনে এমপিদের শপথ নেয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। শরিকদের অন্ধকারে রেখে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিতরা শপথ নেয়ায় সবাই ক্ষুব্ধ। শপথ নেয়ার কারণে দুই নেতাকে বহিষ্কার ও একজনকে শোকজ করা হয়। পরে দলের সিদ্ধান্তেই চার নেতা শপথ নেন। কেন শপথ নিয়েছেন, সে ব্যাপারে বিএনপি বা গণফোরামের পক্ষ থেকে শরিকদের কাছে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। শরিকদের ডেকে কোনো আলোচনাও হয়নি। নির্বাচন নিয়েও নেই কোনো বক্তব্য। উল্টো শপথের বিরোধীরা এখন কোণঠাসা। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা শপথ নিয়েছেন তারাই হচ্ছেন পুরস্কৃত। এ নিয়ে জোটটি ছাড়তে শুরু করেছেন শরিদ দলের নীতিনিধারকরা।
সর্বশেষ মঙ্গলবার জোটের শরিক দল লেবারপার্টি বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছে। এর আগে সোমবার ২০ দলীয় জোট ছাড়ে আন্দালিব রহমান পার্থের জাতীয় পার্টি। ফলে জোটটিতে প্রকাশ্যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
এদিকে, শপথের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে থাকায় অনেক নেতা তিরস্কৃত হচ্ছেন। ফ্রন্টের শরিক গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু দলীয় পদ হারিয়েছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। মন্টুকে বাদ দিয়ে রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
২০ দলীয় জোটের শরিকরাও সবকিছুর ব্যাখ্যা চান। শরিকদের দলের নেতারা বলছেন সবাই একসঙ্গে চলার জন্যই জোট। সেই জোটকে অন্ধকারে রেখে যদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে এর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
শপথকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভেতরেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম। যার প্রভাব পড়েছে দলীয় কর্মকাণ্ডেও। শনিবার স্থায়ী কমিটির পূর্বনির্ধারিত বৈঠক কোনো কারণ ছাড়াই বাতিল হয়ে যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তা প্রত্যাখ্যান করে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট।
কিন্তু রোববার এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, সংসদে না যাওয়ার আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তার এ বক্তব্য জোটের সঙ্গে টানাপোড়েনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বিএনপির মহাসচিব বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়ক গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ ইস্যুতে এখনও কোনো বক্তব্য দেননি। দলীয় এমপিদের সংসদে পাঠানোর পরও তিনি বলছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করা হয়নি। তার এমন বক্তব্যে দলীয় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
পাশাপাশি শপথ নেয়ার পর মোকাব্বির খানকে ধমক দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দেয়া হলেও নতুন কমিটিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে। তাকে সভাপতি পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, মোকাব্বির খানকে ধমকের বিষয়টি ছিল আইওয়াশ। গণফোরামের এমন সিদ্ধান্তে দলটির ভেতরেও শুরু হয়েছে অস্থিরতা। অনেকেই দল থেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
সূত্র জানায়, শেষ মুহূর্তে নির্বাচিত পাঁচ এমপির শপথ নেয়ায় বিপাকে পড়েছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নেয়ার কথা বলার পরও এ নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান। শেষ মুহূর্তে শপথের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কেন তাদের অবহিত করা হয়নি, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
বলতে গেলে শপথকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের দলীয় কর্মকাণ্ডেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। বুধবার মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল রাজধানীতে র্যালি বের করে। ওই র্যালিতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে।
শুক্রবার এক আলোচনা সভায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সবাই পার্লামেন্টে গেল মহাসচিব গেল না কেন- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটা আমার কাছেও খটকা লাগে, দলের সিদ্ধান্তে সবাই গেলে মহাসচিব যাবেন না কেন? আলাদা কারও ভালো থাকা বা আলাদা কারও হিরো হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি কেন সংসদে যোগ দিলেন না, নিশ্চয়ই সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। গয়েশ্বর ছাড়াও অনেকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন।
এদিকে দলের করণীয় চূড়ান্তে তারেক রহমানের নির্দেশে প্রতি শনিবার স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে বসতেন। কিন্তু শনিবার পূর্বনির্ধারিত সেই বৈঠক বাতিল করা হয়। এ নিয়েও দলের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা জানান, শপথকে কেন্দ্র করে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে প্রকাশ্য বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
এ মুহূর্তে বৈঠক হলে তা আরও জটিল হতে পারে। তাই দলের শৃঙ্খলার স্বার্থেই শেষ মুহূর্তে বৈঠক স্থগিত করা হয়। তবে এ ব্যাপারে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অবহিত না করায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হন।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শেষ মুহূর্তে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তে দল এবং জোটের শরিকদের কেউ কেউ কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। কেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি সেই প্রশ্নও তুলছেন। কোন পরিস্থিতিতে কেন শপথের সিদ্ধান্ত সেই বিষয়ে দলীয় নেতা ও জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করব। দ্রুত তাদের সঙ্গে বৈঠকের চিন্তাভাবনা রয়েছে। এ ইস্যুতে যাতে দল ও জোটের মধ্যে কোনো বিভেদ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি না হয়, সেদিকে আমরা সতর্ক আছি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যে পদ্ধতিতে বিএনপি সংসদে গিয়েছে সেভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটি এবং শরিকদের জানিয়েই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। ফলে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক কয়েকটি দলের অভ্যন্তরে বিরোধ বা অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত দল এবং জোটের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব দ্রুত ঘুচিয়ে ফেলা। এ লক্ষ্যে শিগগির তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি খোলাসা করা উচিত।
জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপি শপথের বিষয়ে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ আমাদের কিছুই বলেনি। অন্তত একটা বৈঠক সঙ্গে সঙ্গে ডাকা দরকার ছিল। সেখানে তারা জানাতে পারত যে বিশেষ অবস্থায় শপথের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরে দিব। কিন্তু তারা কিছুই করেননি। বিএনপিকে এখন খোলাসা করতে হবে যে এই কারণে আমরা শপথ নিয়েছি, যাতে তাদের কথা শুনে অন্যদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়। একই অবস্থা গণফোরামের ক্ষেত্রেও। তারাও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে পথ চলতে হলে বিষয়টি শরিকদের জানাবেন বলে আশা করি।
এ প্রসঙ্গে গণফোরামের নতুন কমিটির নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, শপথকে কেন্দ্র করে আমাদের দলে কোনো অস্থিরতা নেই। বরং কয়েক মাসের অস্থিরতার পরিসমাপ্তি ঘটায় আমরা স্বস্তিবোধ করছি।
তিনি বলেন, আমাদের দলের দু’জন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা সঠিক বলেই নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। মোকাব্বির খান শোকজের যে জবাব দিয়েছেন তাও সন্তোষজনক। ফলে তাকে দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। মন্টুকে বাদ দেয়ার সঙ্গে শপথের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি শপথের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি বলে জানান ঐক্যফ্রন্টের এ নেতা।
এক প্রশ্নের জবাবে সুব্রত বলেন, শপথকে কেন্দ্র করে ঐক্যফ্রন্টের কয়েকটি দলের অভ্যন্তরে কিছুটা মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো দূর করার চেষ্টা চলছে। এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক ডাকা হবে। সেখানে সংসদে যাওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে খোলাসা করা হবে।
জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বিএনপি শপথ নিয়েছে তা জোটের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়নি। জোটের বৈঠক ডেকে এ বিষয়ে তাদের একটা ব্রিফ দেয়া উচিত। আশা করছি, বিএনপির মহাসচিব শিগগির জোটের বৈঠক ডাকবেন এবং কি পরিস্থিতিতে শপথের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সবাইকে অবহিত করবেন।
তিনি বলেন, যেখানে আমরা শুরু থেকেই বলছি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, রাতের আঁধারে ভোট কেটে নিয়ে গেছে। এমনকি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এখন বিএনপি সংসদে গেল, যাওয়ার আগেও জোট নেতাদের কোনো কিছু জানায়নি, যাওয়ার পরও জানায়নি। তাই এ নিয়ে জোটের শরিকদের মধ্যে একটা ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.