নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের মহান বিজয় দিবস। বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্ণ হলো আজ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের আজকের দিনে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।
জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে স্মরণ করবে সেসব শহীদকে যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। স্মরণ করবে সেসব বীর সেনানীকে যারা শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়ার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যেসব নর-নারীর সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্মান জানানো হবে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি উদযাপনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বুটের তলায় স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর এক হত্যাযজ্ঞের অপারেশনে নামে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি হঠকারী শাসকগোষ্ঠী। আলোচনার টেবিলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ পরিত্যাগ করে তারা বন্দুকের নল আর কামানের গোলা বেছে নিলো সমাধানের উপায় হিসেবে। যুদ্ধ চাপিয়ে দিলো আমাদের ওপর। নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যায় মেতে উঠল অস্ত্রের জোরে বলীয়ান সামরিক শাসকগোষ্ঠী। শুরু হলো মুক্তির লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ।
ব্রিটিশদের বিদায়ের পর নতুন রূপে এ জাতির ওপর শোষক হিসেবে আবির্ভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এক দিন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে আন্দোলন করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকেই আবার অস্ত্র ধরতে হলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতা, অদূরদর্শিতা এবং অবিমৃষ্যকারিতার কারণে দুই অঞ্চলের মধ্যে তৈরি হয় ভেদরেখা এবং বৈষম্যের বেড়াজাল। পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলা চরম আকার ধারণ করলে প্রতিবাদে ক্রমে অগ্নিগর্ভ হতে থাকে এ অঞ্চল। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি কর্র্ণপাত না করে বুটের তলায় তা পিষ্ট করার নীতি গ্রহণ করে তারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে টালবাহানা শুরু করে শাসকগোষ্ঠী।
ফলে ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহাকে প্রবল করে তোলে। ঢাকা যখন অগ্নিগর্ভ, তখন পাকিস্তানি শাসকচক্র আমাদের মুক্তির স্পৃহাকে দমনের পথ বেছে নেয়। রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার মাধ্যমে জন্ম দিলো ২৫ মার্চের কালরাত্রি। এরপরই চূড়ান্ত হয়ে যায় আমাদের পৃথক পথচলার যাত্রা। ওদের সাথে আর নয়। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াই। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিসংগ্রামের পর পরাজয় মেনে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৯১ হাজার ৪৯৮ জন নিয়মিত-অনিয়মিত এবং আধা সামরিক সৈন্য নিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমপর্মণ করেন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পথচলা।
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে এবার ইউনেস্কো বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয়ায় এবারের বিজয় দিবসকে ভিন্ন ব্যঞ্জনা দিয়েছে।
প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ : প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
এরপর বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাগণ, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকগণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর আমন্ত্রিত সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। শহীদদের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে।
বিজয় দিবসে জনতার ঢল নামবে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধার সাথে তারা শহীদদের উদ্দেশে নিবেদন করবেন পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসে।
কুচকাওয়াজ : সকাল ১০টায় তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী এবং ফায়ারসার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এ সময় বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও অ্যাকরোবেটিক ডিসপ্লে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রীও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
বিজয় দিবসে বিভিন্ন আয়োজন : মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মুনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। হাসপাতাল, জেলখানা, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ, সরকারি শিশুসদন, বিভিন্ন অনাথ আশ্রয়কেন্দ্র এবং এ জাতীয় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরগুলো বিনা টিকিটে উন্মুক্ত রাখা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং রাতে আলোকসজ্জা করা হবে। প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাদকদল বাদ্য বাজাবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। রেডিও টেলিভিশনে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।
এ ছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করবে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা সদর ও জেলার অন্যান্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কর্মসূচি
বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ রাজধানীর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে।
এর মধ্যে আছে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বেলা ৩টায় বিজয় শোভাযাত্রা সহকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হয়ে শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় র্যালি শুরু হবে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর বেলা ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন। এ ছাড়াও ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৃষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর সেখান থেকে ফিরে সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের মাজারে দোয়া অনুষ্ঠান এবং ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.