মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল; বিয়েবাড়িতে বিষাদের ছায়া !

0
918
blank
শিব্বির আহমদ ওসমানী
blank

শিব্বির আহমদ ওসমানী: বিয়েবাড়িতে ছিল সাজসাজ রব। সবাই প্রস্তুত নববধূকে বরণ করে নিতে। হঠাৎ একটি খবর সব কিছু ওলটপালট করে দিল। ভঙ্গ করে দিল সকল স্বপ্ন। আনন্দমুখর বিয়েবাড়িতে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। ওই বাড়ির বর তার বাবাসহ আটজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রূপসপুর গ্রামে এখন চলছে শোকের মাতম। নববধূকে বরণের পরিবর্তে বাড়ির সবাই এখন অপেক্ষায় স্বজনদের লাশের। ১৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের শশই নামক স্থানে একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে বরযাত্রী বহন করা মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের রূপসপুর গ্রামের বর ছাত্রনেতা আবু সুফিয়ান, তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা ঢাকার মহাখালীর কনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের শশই নামক স্থানে সকাল ৯টার দিকে এনা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে ঘটনাস্থলেই সাতজন নিহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন। এতে সকল স্বপ্ন মুহুর্তে ওলটপালট হয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন কত পরিবারের কত স্বপ্ন ভেঁঙ্গে ওলটপালট হচ্ছে তা আমাদের জানার বাহিরে। কত জীবন অকাতরে চলে যাচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
ঈদের ছুটিতে সড়কপথে চলাচলের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়েই চলছে—এই সত্য জানা থাকা সত্ত্বেও যানবাহনের চালকদের একাংশের বেপরোয়াভাবে যান চালানোর প্রবণতা কোনভাবেই কমছে না। গত ঈদুল ফিতরের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ১৫ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে, ঈদুল আজহার সময় তা বেড়ে হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১৮ জনের বেশি।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার খুব বেশি। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই হার প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মাত্র ৩। আর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কত লোক নিহত হয়, তা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি তিন-চার হাজারের বেশি নয়, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে তা ২০ থেকে ২১ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামের এক বেসরকারি সংস্থা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখেছে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮ হাজার ৬৪২ জন।
এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বহুমুখী। নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে যান চালানোর প্রবণতা প্রধান কারণগুলোর একটি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সড়কের সংকীর্ণতা, বিপজ্জনক বাঁক ইত্যাদি সমস্যাকে ছাপিয়ে যায় বেপরোয়া যান চালানোর প্রবণতা। অনেক চালক রাস্তা ফাঁকা পেলেই যানবাহনের গতি বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়িয়ে দেন, ফলে দুর্ঘটনা বেশি হয়, হতাহত মানুষের সংখ্যাও অনেক বাড়ে। বেপরোয়া যান চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানির দায়ে চালকের বিচার ও শাস্তি হয় না। এমনকি শাস্তির দাবি উঠলে, কিংবা মামলা হলে মোটরযান শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন, মন্ত্রী পর্যায়ের নেতারাও সেই অন্যায় আন্দোলনে ইন্ধন জোগান। এভাবে চালকদের দোষে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাগুলো প্রতিকারহীন থেকে যায়। মোটরযান আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় দণ্ডিত চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড; কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ নেই; দণ্ডবিধির অধীনে মামলা হলে সে মামলার নিষ্পত্তি হয় না।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ—সবাই যেন ধরে নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও অঙ্গহানি যেন স্বাভাবিক সমস্যা। কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। যানবাহনের চালকদের বেপরোয়া যান চালানো দ্রুত বন্ধ করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন যানচালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন যেন রাস্তায় নামতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ লাশের মিছিলকে থামাতে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি গনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।
ই-মেইল: sahmedosmani@gmail.com