মোসাদ বিতর্ক এবং চাপা পড়া আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ইস্যু

0
1005
blank
blank

গোলাম মোর্তোজা: আকারে ছোট, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র ইসরায়েল। মেধা-আর্থিক-সামরিক সব দিক দিয়েই। আমরা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করি না, পছন্দ করি না, মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুতে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের উপর ইসরায়েলের বর্বরতম নির্যাতন-হত্যাকান্ড সবারই জানা। ইসরায়েলের প্রতি আমাদের মনে এক ধরনের ঘৃণা কাজ করে। সেই ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সখ্যতা গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। দেশ-বিদেশে চলছে রাজনৈতিক বক্তৃতা। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়েও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশে যখন এই আলোচনার ঝড় বইছে, তখন ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে জোরেসোরে কাজ শুরু করেছে। শিক্ষক নির্যাতন নিয়েও দেশে চলছে প্রতিবাদ। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কোনটি? ইসরায়েলের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়টিই বা কি?
এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
১. প্রথমেই ইসরায়েল-বিএনপি সম্পর্ক বিষয়ে আসি। ইসরায়েলের একজন রাজনৈতিক নেতা-চিন্তাবিদের সঙ্গে বিএনপির একজন নেতা বৈঠক করেছেনÑ ভালো কোনো সংবাদ নয়। সেখানে যদি দেশ বা সরকার পতন বিষয়ক আলোচনা বা ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে তবে তো অভিযোগটি ভয়াবহ। তদন্ত করে অবশ্যই এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এতে কারও দ্বিমত থাকা উচিত নয়, আমারও নেই। প্রশ্ন হলো, সেই বৈঠকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হয়েছে কিনা? এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা গেছেÑ
ক. ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির প্রভাবশালী নেতা মেনদি এন সাফাদি মাঝেমধ্যেই ভারতে আসেন। ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ে তিনি কাজ করেন। যে বৈঠকের কথা আলোচনা হচ্ছে, তখন তিনি ভারতে এসেছিলেন ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে। সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই বিএনপির হঠাৎ নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সাফাদির বৈঠক হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছে।
খ. লক্ষণীয় বিষয়, বাংলাদেশের সরকার পতন বিষয়ক ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে ভারতের মাটিতে। যার সঙ্গে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী ‘ষড়যন্ত্র’ করছেন, তিনি ভারতে এসেছেন বিজেপি নেতার আমন্ত্রণে। বিজেপি মানে ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল।
গ. বিজেপি সাফাদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছে, নিশ্চিত করেই বলা যায় তা ভারত সরকারের জানামতেই হয়েছে। কারণ ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক উন্নয়নই তাদের মূল লক্ষ্য।
ঘ. বিষয়টি কী তাহলে এমন, ভারত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছে, তার সঙ্গে ভারতের মাটিতে বিএনপির এই অখ্যাত হঠাৎ নেতা বাংলাদেশ সরকার পতন বিষয়ক ষড়যন্ত্র করছে? এটা কি ভারতের জানামতে ঘটছে না অজানা থাকছে পুরো বিষয়টি?
সবাই জানি ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ও অত্যন্ত দক্ষ। মোসাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতা ‘ষড়যন্ত্র’ করবেন এবং সেটা ভারতের মাটিতে, তা ‘র’ বা ভারত সরকার জানবে না, কোনো শিশুর পক্ষেও তা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
ঙ. আবার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বা বর্তমান সরকারের যে সম্পর্ক তাতে এ কথাও অবিশ্বাস্য যে, ভারত ভারতের মাটিতে বসে, বিএনপিকে বাংলাদেশ সরকার পতন বিষয়ক ষড়যন্ত্র করতে দেবে। আর যদি তা দিয়ে থাকে তাহলে এই ‘ষড়যন্ত্র’ শুধু বিএনপি-ইসরায়েল করছে না। করছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি, ভারত সরকার, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং বিএনপি সম্মিলিতভাবে। এক্ষেত্রে বিএনপি ‘ষড়যন্ত্র’ করছে বললে, অভিযোগটি খুব হালকা হয়ে যায়। যদি আওয়ামী লীগ সরকার এই ‘ষড়যন্ত্রে’র বিষয়টি সত্যি মনে করে, তবে ভারতের থেকে অনেক কিছু জানতে চাওয়ার আছে। কিন্তু অভিযোগের কোথাও ভারত বিষয়ক প্রসঙ্গ আসছে না। তবে কি প্রসঙ্গ সামনে আনার মতো ভিত্তি নেই? শুধু রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে, সুবিধা নিতে চাইছে আওয়ামী লীগ সরকার?
২. রাজনীতিতে সাময়িক সুবিধার জন্যে আমরা ‘গুরুতর’ অভিযোগও উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামনে আনতে দ্বিধা করি না। আবার গুরুতর প্রসঙ্গগুলো চাপা পড়ে যায়। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ যে প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তা নিয়ে ভারতের ভেতরেই তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া আছে। এই নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ভারত অন্য দিকে নিয়ে যাবে। ভারতের কিছু অঞ্চল যেমন উপকৃত হবে, কিছু অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। ভারত থেকে আসা আন্তর্জাতিক ৫৪টি নদী থেকে এমনিতেই আমরা পর্যাপ্ত পানি পাই না, ভারতের দেয়া বাঁধের কারণে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানি আসবে না, শুকিয়ে যাবে, মরুভূমিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি, এত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে দেশে কোনো আলোচনা নেই, রাজনীতি-গণমাধ্যম-বিশেষজ্ঞ… কোনো পর্যায়েই! যা বিস্ময়কর!
অহেতুক-অপ্রাসঙ্গিক-অপ্রয়োজনীয় ইস্যুগুলোকে দিয়ে, আমাদের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ইস্যুগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বি: দ্র: অচিরেই হয়ত আমরা শুনব, বাংলাদেশের জন্যে ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু করবে না ভারত। বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি সবই ঠিক করে দেবে ভারত? ভালো, বেশ ভালো।