রাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ

0
958
blank
blank

মাসুদ মজুমদার: দু’হাজার সতেরো সাল শেষ হতে যাচ্ছে। আগামী লেখাটা হবে আঠারো সালের শুরুতে। গ্লানিমুক্ত হয়ে নতুন বছরটি শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। অতীতের পিছুটান ছাড়ছে না। জাতীয় রাজনীতির জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ, সমঝোতার। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা প্রদর্শনের। এ দু’টি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার পরই অন্য চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসবে।

সরকার কসমেটিক উন্নয়নের ফিরিস্তি দেখিয়ে নির্বাচনী আসর জমিয়ে তোলার কথা ভাবছে। সরকারি দলের ধারণা- এই প্রক্রিয়ায় সব সঙ্কট উৎরানো সম্ভব হবে। সুশাসনের অভাব এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি জনগণকে বেশি ভাবাবে না।’ তা ছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের আওতায় এসে গেছে। কোনোভাবে নির্বাচনে বিরোধী দলকে জড়িয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। কারণ জনগণ ভোট দেয়ার যতটুকু সুযোগ পাবে- ততটুকু সুযোগ হাতিয়ে নেয়ার মতো অবকাঠামো আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে করে রেখেছে বলেই সব বিরোধী দলের ধারণা। রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে অঙ্গসংগঠনগুলোর তৎপরতাও বেড়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার কাঠামো পুরোটাই কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাইতে বাধ্য। মহল্লার ক্লাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ফোরাম সরকারি দলের দিকে ঝুঁকে আছে। এই অবস্থাটা ততক্ষণ কাটবে না যতক্ষণ ভোটারদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের সুযোগ মিলবে না। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে; ঠাণ্ডামাথায়। রোগটা গণতন্ত্রহীনতার ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে। গণতন্ত্র চর্চার অভাবে প্রায় একদলীয় আদলে দেশ পরিচালিত হয়েছে। বাকি সব গণতন্ত্রহীনতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

তাই বিএনপির ‘সহায়ক সরকার’ ধারণা যতক্ষণ না পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণের ভোটদানের বিষয়টি খোলাসা করে অনুমান করা সম্ভব হবে না। সহায়ক সরকার ধারণা ইতিবাচক। কিন্তু এর রূপরেখা পরিষ্কার এবং খোলামেলা হওয়া জরুরি। স্বভাবতই জনগণ জানতে চাইবে, সহায়ক সরকারের ধারণাটা কেমন হবে? কিভাবে এই সরকার গঠিত হবে? তাদের দায়বদ্ধতাই বা কী হবে? বিএনপি সুযোগ পেলেই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ধারণাও উপস্থাপন করছে। এর মাজেজাটা স্পষ্ট করা দরকার। যা সহায়ক সরকার সেটাই কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার? এখানে জনগণের কাছে পরিষ্কার বার্তা দেয়ার দায়িত্ব বিএনপির। সমঝোতার স্বার্থেও একটা প্রস্তাব চাই। তারপর আলোচনার মাধ্যমে সব কুল রক্ষার মতো কিছু একটা দাঁড়ানো সম্ভব।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি দেখে মনে হতে পারে, দেশে বিএনপি নামক কোনো দলের অস্তিত্ব থাকার আর কোনো দরকার নেই। আবার উল্টো মতও দেখা যায়। আওয়ামী লীগ যেমন রাজনীতিতে আছে থাকবে, তেমনি বিএনপিও অস্তিত্ব নিয়েই টিকে থাকবে। বাস্তবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুটো ধারা ও দুটো কনসেপ্ট। তৃতীয় স্রোত প্রবলভাবে এগিয়ে না এলে এই দ্বিধারার রাজনীতি হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। কারণ রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং পরিবারকেন্দ্রিক থেকে গেছে। এটাকে হঠাৎ করে লীন হয়ে যাবে না।

এখনো আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষজন শেখ হাসিনার পর রেহানা কিংবা জয়কে নিয়ে ভাবতে আগ্রহী। একইভাবে, বিএনপিপন্থীদের মনে তারেক রহমান ও জোবায়দা এখনো ভাবনায় রয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস সর্বশেষ উপমা হয়ে থাকল- পরিবারতন্ত্র কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়।

যিনি যেভাবেই মূল্যায়ন করুন, বিএনপির জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সমার্থক হয়ে আছে। তেমনি আওয়ামী ধারার রাজনীতিও সমান অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। প্রধান দুটো দলে রূপান্তর হতে পারে, নেতৃত্বের অদল বদল হতে পারে; কিন্তু বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয় না হলে দ্বিধারার রাজনীতির বিলুপ্তি ঘটবে এমনটি বলা কঠিন। অন্তত আপাতত সেই সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাই একটি ধারাকে উপেক্ষা করে অন্য ধারা এ দেশের রাজনীতিতে স্থিতি আনতে সক্ষম হবে না।

শক্তিমান কয়েকজন জাতীয় রাজনীতিবিদ একটি জোট গঠন করেছেন। অবশ্যই এমন জোট ইতিবাচক। রাজনীতিকে ভারসাম্য দেয়ার জন্য এ ধরনের ব্যক্তিত্বের ভূমিকা মধ্যস্থতাকারীর মতো হতে পারত। তারা দলীয় ইমেজ নিয়ে সেই অবস্থানে টিকে নেই। তাই তারা প্রধান শক্তি হওয়ার ইচ্ছা রাখেন, সামর্থ্য রাখেন না। এর পরও জাতীয় রাজনীতিকে ভারসাম্য উপহার দেয়ার জন্য তাদের সরব উপস্থিতির একটি ইতিবাচক প্রভাবের সুফল জাতীয় রাজনীতি পেতে পারে।

এ ধরনের জোট বিরোধী দলের জন্য হতে পারে আশীর্বাদ। অবশ্য যদি জাতীয় নির্বাচন অর্থবহ হয়, তবেই। নয়তো এ ধরনের জোট শেষপর্যন্ত সুফল বয়ে আনতে পারে না। কারণ ধারাবিভক্ত রাজনীতিতে ছোট দলের বড় নেতারা রাজনীতিতে শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু এককভাবে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারেন না। এই না পারার রাজনীতিকে ধারা বিভক্ত রাজনীতির কুফল বলা চলে। এর তাৎক্ষণিক সমাধান দ্বিধারার রাজনীতিতে নেই। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্য কিছু ভাঙা-গড়া অপেক্ষা করে। জোট ভাঙে, দল ভাঙে, নতুন জোট তৈরী হয়। মেরুকরণও হয় নতুনভাবে। এ কারণে জাতীয় রাজনীতির কোনো ক্ষতি হয় না। বরং জাতীয় রাজনীতি প্রত্যেকটি জাতীয় নির্বাচন শেষে একবার মোড়ক পাল্টায়; ধরনও পাল্টায়। জাতীয় নীতিতে কিছু পরিবর্তন আসে। তাই গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জাতীয় নির্বাচন জঞ্জাল সাফ করার দায়ও নেয়। এতে ক্ষমতা পাল্টায়, ব্যক্তি পাল্টায়। সেই সাথে রাজনীতির ধরন-ধারণেও কিছু পরিবর্তন আসে। অনেক পুরনো নেতা ঝরে পড়েন; নতুন প্রজন্ম সামনে এসে যায়।

এ কারণেই জাতীয় রাজনীতিতে পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন একটি রাজনৈতিক মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। অতীত দেখুন, প্রত্যেকটি জাতীয় নির্বাচন কিছু দেয়, কিছু নেয়। দেয়া-নেয়ার মাঝ দিয়ে জাতি কিছু গুণগত পরিবর্তন আশা করে। সেটা ষোলো আনা পাওয়া না গেলেও নগদ কিছু পাওনা হয়ে যায়।

এ কারণেই হার-জিতের প্রশ্ন উহ্য রেখেও একটি জাতীয় নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। এই উচিত-অনুচিত নীতিশাস্ত্রের বিষয় নয়, রাজনীতির বিষয়। গ্রহণযোগ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়ার দাবিটা নৈতিক কারণে। তা না হলে ১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এত মাথাব্যথার কারণ হতো না। সেই নির্বাচনে রাজনীতি ছিল; তবে নীতি ছিল না। নীতিকে লোপাট করে রাজনীতি এগিয়ে যাওয়ার কারণে খেসারতের অঙ্কটা বেড়ে গেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। গণতন্ত্রের আসল কাঠামো ভেঙে পড়েছে। আইনের শাসন কার্যকর হতে পারেনি। ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতার কোনো জায়গা রাখা হয়নি। যারাই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, মালির বাগানের মতো তাদের কেটে সমান করে সাজানো হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রও নয়; ক্ষমতার ইচ্ছায় একচ্ছত্র শাসনের নমুনা মাত্র।

একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ যে রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিকতার আদর্শবাদের শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছেÑ তা ভরাট করার আর কোনো ব্যবস্থা নেই। অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চার পথে সেই শূন্যতা ঘুচবে না। সামরিকতন্ত্রের মাধ্যমে সেই অভাবের কূলকিনারা পাওয়া যাবে না। গোজামিলের শাসনেও সমাধান নেই। তাই গণতন্ত্রই এখন একমাত্র ধন্বন্তরী। এর মাধ্যমে মানুষের মনে যে রাজনৈতিক শূন্যতাজনিত হাহাকার, সেটা ঘুচবে শুধুই গণতন্ত্রের নতুন বাতাবরণে অবগাহনের মাধ্যমে। গণতন্ত্র সব সমস্যার সমাধান নয়; কিন্তু আপাতত শূন্যতা ঘোচাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের জানা মতে, বড় দলগুলোর নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে চায়, তবে ‘মোটামুটি’ গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। বিএনপি ‘মোটামুটি’ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে সরকার গঠনের ব্যাপারে আশাবাদী। বড় দু’টি দলের আশাবাদের ভেতর একটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে আছে। এটাই আপাতত রাজনীতির জন্য আশাবাদের মূল কারণ। বাকি পরিস্থিতি জাতীয় রাজনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকল।

masud2151@gmail.com