শুভ বুদ্ধির সাথে হোক শুভ চিন্তার উত্থান

0
1068
blank
blank

সাজজাদ হোসাইন খান: শুভ চিন্তা, শুভ বুদ্ধি কোনটারই যেন আর অবশিষ্ট নাই দেশে, সমাজে। কেবলই চতুরতা, হিংসা-বিদ্বেষ। বিভেদ বিভাজনের এক জগদ্দল পাথর জাতির মনমানসিকতায়, বুদ্ধি-বিবেচনায়। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু ভিন্নতা এখন বিদ্বেষে রূপ নিচ্ছে। এই বিদ্বেষের কারণেই ঘটছে অঘটন প্রতিনিয়ত। এক রৈখিক দৃষ্টি বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার হোন কেউ কেউ। এমন তৎপরতা কখন উঠে আসে, যখন অন্যের মতটি তাদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না। অথবা বিভ্রান্তিকে চিহ্নিত করে যৌক্তিক ধারায়। সহনশীল মনোভঙ্গির অভাব মতান্তরকে মনান্তরে রূপ দেয়। যা অবশেষে উচ্ছৃঙ্খলতায় গিয়ে ঠেকে। দেশ এবং জাতি সেই উচ্ছৃঙ্খলতারই মুখোমুখি বর্তমানে। আমি যদি অন্যের মতকে সম্মান না দেই তখন তো আমার মতও উপেক্ষিত হবে। তবে এটি ঠিক অযৌক্তিক বা বিভ্রান্তিমূলক মতামত অথবা আচরণ সমাজে অস্বস্তি এবং অস্থিরতারই জন্ম দেয়। এই অস্থিরতা ও অস্বস্তিকর সময়ই যেন পার করছে দেশ-জাতি। বাকস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন সঠিক নয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভিন্নমতকে দলিত করাও স্বাভাবিক পন্থা নয়। এরপরও এই অস্বাভাবিক পন্থাটিই দেশময় তার শাখা প্রশাখা বিস্তারে ব্যস্ত। বলার অধিকার অথবা প্রতিকার প্রতিবিধানের বিধিসম্মত প্রকাশের ইচ্ছাকেও যদি অবদমন করা হয়, ক্ষমতা প্রদর্শন করে তখন তো ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেই পারে সমাজে। ক্রিয়াস্বরূপ সামাজিক শৃঙ্খলা ধরে রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তখনই সমাজ-সংসারে হিংসা-বিদ্বেষ উচ্চকিত হয়। যা কিনা হানাহানি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। বর্তমানে দেশময় যে ধরনের হানাহানি বিস্তৃতি পাচ্ছে তা অবশ্যই একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর অশুভ চিন্তা এবং অশুভ বুদ্ধির প্রয়োগেরই ফল।

অপরাধ তো অপরাধই। অপরাধীকে বিভাজিত করা উচিত নয়, এটি অন্যায়। মুশকিলের বিষয় হলো এ অন্যায় কর্মটিই হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই অপরাধে অপরাধী অবস্থা ভেদে একজন চলে যাচ্ছে শাস্তির আওতায় অন্যজন ‘ধোয়া তুলসি পাতা’। অন্যায়-অবিচারেও খোঁজা হয় পক্ষ-বিপক্ষ। পক্ষপাতমূলক বিবেচনা শুভ বুদ্ধিকেই দলিত করে। যে কারণে অপরাধ বাড়ছে বৈ কমছে না। শুভ চিন্তার চর্চা না থাকলে শুভ বুদ্ধির জাগরণ আসবে কোত্থেকে? বর্তমানে শুভ চিন্তা এবং শুভ বুদ্ধির বড় বেশি অভাব। বলা যায় খরা চলছে। যে কারণে ফসলের মাঠে এখন শুধুই মরীচিকা। এই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ আশাহত, বিভ্রান্ত। দেশের প্রতিটি প্রান্তেই যেন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে কৌশলে। ক্ষমতাবানরা স্বৈর মনোভাব প্রদর্শন করতেই পারে। এটিই তাদের প্রধান হাতিয়ার। ক্ষমতাকে পুষ্ট করতে পোক্ত করতে। অত্যাচার, অবিচার এবং লোভের উপঢৌকন তো কৌশলের আরেক মাত্রা। এসব কৌশল যখন সীমা অতিক্রম করে তখনই ঘনিয়ে আসে বিপদ। এই বিপদ যেমন স্পর্শ করে শাসকশ্রেণীকে তেমনি বিপদে নিপতিত হয় দেশ-জনতা। মানুষ বর্তমানে সেই বিপদের ক্রান্তিকালে উপনীত। চারদিকে শুধু হতাশা অসহায়ত্বের আর ভীতির ভয়াল থাবা। ভীতির মধ্যেই যেন দিনাতিপাত করছে মানুষ। বিপদ এখন ঘনিয়ে আসছে চতুর্মুখী। এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বুঝি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বলা যায়, রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। রুদ্ধ দুয়ারে বাধাগ্রস্ত হয়েই মানুষের বুদ্ধিবিবেচনা বেপথ হচ্ছে ক্রমশ। বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা খুনখারাবি এই অস্বস্তির কুফল কিনা কে জানে।

হত্যা সে প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্যেই হোক তা সার্বিক বিবেচনায় নিন্দনীয়। শাস্তিযোগ্য অপরাধ তো বটেই। কিন্তু অস্বস্তির খবর হলো এক খুন কোন কোন গোষ্ঠীকে জাগিয়ে তুলে অন্য খুনে তারা ঘুমঘোর। এমন আচরণ কোন অবস্থায়ই সমর্থনযোগ্য নয়। হত্যা বা খুন বিষয়টি বিষাদময় দুঃখজনক। এখানে জাগরণের মাত্রা যেমন বিবেচনায় রাখতে হয় পাশাপাশি নিদ্রার ব্যাপারটিও প্রকাশ্যে আনা উচিত নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য ইদানীং তেমনটাই দেশবাসী অবলোকন করছে। লাশ নিয়ে সাজানো হচ্ছে রাজনীতির মঞ্চ। মৃত্যু একটি হৃদয়মথিত ঘটনা। হত্যা হলে তো বক্ষবিদীর্ণ করে বিশেষ করে রক্তের বন্ধনে যারা আবদ্ধ। তাদের উপস্থিতিতে যখন তার বুকের ধনকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়ে তখন দুঃখের আর অবধি থাকে না। হত্যাকারীকে পাকড়াওয়ের পরিবর্তে নানা আবলতাবল বাক্যবাণে অতিষ্ঠ করে তোলে তারা। শাসকশ্রেণীর বড় কর্তারা যেমন ¯্রফে রাজনৈতিক স্বার্থে অসত্য-অন্যায় বাক্য ব্যয় করেন, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের একশ্রেণীর বশংবদ বুদ্ধি ব্যবসায়ীও একই সুরে জেগে ওঠেন। যা বিষয়টিকে আরো ঘোলাটে করে তোলে। এ রকমের প্রলাপের গলিপথে আসল অপরাধী উদ্ধার পেয়ে যায় নির্বিঘ্নে। পরবর্তী সময় একই অপরাধ বা আরো ভয়াবহ অপরাধে ওরা জড়িয়ে পড়ে। যে কারণে অবসান হচ্ছে না হানাহানি খুনাখুনির। কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও যখন পক্ষপাতমূলক আচরণ প্রদর্শন করেন তখন নিরীহ জনতা হতাশায় নিপতিত হয়। শিক্ষিতজনদের কাজ হলো দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করা। মঙ্গলকে উচ্চকিত করা। হতাশার বিষয় হলো তেমনটি লক্ষ্যযোগ্য নয়। নয় বলেই দেশে শুভবুদ্ধি আর শুভ চিন্তার বৈকল্য দেখা দিয়েছে। অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস যেন হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। লোভ-লালসায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই এমনটা ঘটছে। একটি জাতির মাথার উপর যখন অমঙ্গলের ছায়া বিস্তৃত হতে থাকে তখন শিক্ষিতজনদের চিন্তার বিভ্রাট এজন্যে দায়ী হয় অনেকটাই। দেশের যা ঘোলাটে অবস্থা তাতে তো এমন ধারণাকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তাছাড়া এই শ্রেণীটির ইদানীং যা কর্মকা- সেখানে তো এর বাইরে চিন্তা করার আর কোন অবকাশ থাকে না। শাসনত্রাসনে উত্তাল এখন দেশ। তাই ভাবপ্রকাশে কুণ্ঠিত জনগণ। নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছে গণতন্ত্র। এখানে দ্বিতীয় পক্ষের অনুপস্থিতি। মত প্রকাশের অধিকার কেবল একপক্ষের। দ্বিতীয়পক্ষ ভয়ে বিহ্বল। তাই সেখানে কবরের নীরবতা। এমন ব্যবস্থা কতটা ন্যায়ানুগ সে বিষয়টির প্রতিও ভ্রুক্ষেপ নেই সেই শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিমানদের, জাগুরুকদের। তারা কেবল হিজমাস্টার ভয়েসের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারলেই যেন ধন্য।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার জন্যেই অবারিত হওয়া উচিত। তবে সে মতে কল্যাণ-অকল্যাণের পরিমাণটি কতটুকু তা পরিমাপ করে দেখা দরকার। বিশেষ করে শিক্ষিতজনদের। দেশের মঙ্গলাকাক্সক্ষী যারা তাদের। প্রশান্তির জন্যে বাতায়ন খোলা রাখে অনেকে। কিন্তু সে বাতায়ন পথে শীত হাওয়ার সাথে যদি দুর্গন্ধ প্রবেশ করতে থাকে তখন তো বাতায়ন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকে না। মতামতের বিষয়টিও সে পর্যায়েরই একটি ব্যাপার। পরিমাপ করে জানতে হবে সেখানে কল্যাণের ভাগ কতটুকু। কল্যাণকে গ্রহণ করতে আপত্তি থাকবে কেন? এখানে ভিন্নমতও থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। এরপরও সার্বিক বিবেচনার তুল্যমূল্যে দুর্গন্ধ নয়, সুগন্ধকেই তো গ্রহণযোগ্যতায় আনতে হবে। আনা উচিত। অন্যদিকে মতের মিল না হলেই খড়গহস্ত হতে হবে এমন দুর্বৃত্তকে তো অবশ্যই প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এ প্রয়োজনটিতে অস্বচ্ছ রাজনীতির পথ আগলে দাঁড়ানোর কারণে সুস্থতা ফিরে আসছে না। বিদ্বেষ ছড়ানো কোন সুবুদ্ধির বা সুচিন্তার পরিচায়ক নয়। সে বিদ্বেষ বা ঘৃণা মুক্তমনেই ছড়ানো হোক কিংবা বদ্ধমনেই হোক এমন মতামত কখনো কল্যাণকে ধারণ করে না। যেখানে কল্যাণের উপস্থিতি নাই সেখানে সুবিবেচনা তালাশ করা বাতুলতা মাত্র।