শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস: অধ্যক্ষ শিব্বির আহমদ ওসমানী

0
1565
blank
blank

অধ্যক্ষ শিব্বির আহমদ ওসমানী: পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। এ দিনটি পৃথিবীর সব দেশে শ্রমজীবী মানুষের জন্য ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইতঃপূর্বে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের জন্য শ্রমের কোনো সময়কাল নির্ধারণ ছিল না। এতে শ্রমিকদের অত্যাচারের সীমা থাকত না। শ্রমিকদের ১৫/১৬ ঘন্টারও অধিক সময় কাজ করতে হতো। দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম ও হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে দৈনিক আট ঘন্টা শ্রমের দাবি বাস্তবায়িত হয়। এ দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক তার জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন আমরা তাদের কথা কখনো ভুলবো না। ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর সকল দেশেই পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন সমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ দিবসটি পালন করে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে থাকে।

১৮৭২ সালে কানাডায় শ্রমিক আন্দোলন সফলতা লাভ করলেও ১৮৮৪ সালে Federation of Organized Trade and Labor Union নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। অতঃপর ১৮৮৬ সালের ১ লা মে থেকে দৈনিক আট ঘন্টা বৈধ কর্মদিবস হিসেবে পালন করার জন্য এই সংস্থা সিদ্ধান্ত গ্রহন করে এবং সমগ্র বিশ্বে শ্রমিকদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ ধর্মঘটের আহবান জানালে পুজিঁবাদী শক্তি তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। অবশ্য কিছু কিছু পুঁজিবাদী সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলন বানচাল করার জন্য নাশকতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। বরং তাদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যার্থ করে শ্রমজীবী মানুষ সফল হয়।

১৮৮৬ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বের সব শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আড়াই লক্ষ শ্রমিক অংশগ্রহন করে। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল যক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতি (International Working People’s Association) এ আন্দোলনের সূত্রপাত করে।

এই শ্রমিক আন্দোলন ক্রমবর্ধমান বৈপ্লবিক চরিত্র পরিগ্রহ করায় পুঁজিবাদী সমাজ আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়ে। তারা তাদের অর্থায়নে ও পুঁজিবাদী প্রশাসনের সহযোগিতায় এই শ্রমিক আন্দোলন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে পুলিশ ও মিলিশিয়াদরে সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়। ধর্মঘটকারীদের প্রতিহত করার জন্য এই ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদী মহল ইলিনয় ন্যাশনাল গার্ডের জন্য ২০০০ মিশিনগান ক্রয় করে।

এতদসত্ত্বেও ‘পহেলা মে’ নাগাদ এই আন্দোলনে শিকাগোর অনেক মুচি, দর্জি ও পেকিং হাউজ ওয়ার্কাররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। ১৮৮৬ সালের ৩রা মে মেককরমিক রিপার ওয়ার্কারস ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৪ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়। আন্দোলনকারীরা প্রতিবাদে পরের দিন ‘আমোরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে’ গনসমাবেশের ডাক দেয়।

এই সমাবেশ যখন শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হচ্ছিল এবং শেষ বক্তার বক্তব্য শেষে যখন জনতা বিদায় নিতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ১৮০ জন পুলিশ স্কোয়রের দিকে অগ্রসর হয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অতঃপর পুলিশের আক্রমনে একটি বোমা ছোড়া হয়। বোমার আঘাতে একজন শ্রমিক নিহত হয় এবং পঞ্চাশ জন শ্রমিক আহত হয়। তবে যদিও কখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, বোমাটি কে বা কারা নিক্ষেপ করেছিল। তথাপি এ ঘটনা সত্য যে শ্রমিকদের আন্দোলন দমনের কাজেই এই বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশ আন্দোলনকারীদের বাসা-বাড়ী ও অফিসে ভাংচুর চালায় এবং বিনা অপরাধে শত শত শ্রমিককে গ্রেফতার করে। আন্দোলনকারীরা নিগৃহীত হয় এবং শিকাগোর সবচেয়ে সক্রিয় আটজন শ্রমিককে হে মার্কেট বোম্বিংয়ের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত করে দোষী সাব্যস্থ করা হয়। কোনো প্রকার তথ্য প্রমান ছাড়াই কোর্ট আটজনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আলবার্ট পারসন্স, আগস্ট স্পাইস, এডলফ ফিশার এবং জর্জ এঞ্জেলকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, লুইস লিংগ কারাগারে আত্মহত্যা করেন। বাকি তিন জনকে ১৮৯৩ সালে ক্ষমা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং মূলধারার ইউনিয়ন কর্মকর্তাবৃন্দ মে দিবেসের ইতিহাসকে অনেকবার মূছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এই দিনটিকে তারা কেবল মস্কোর রেড স্কোয়ারে উদযাপিত একটি ছুটির দিন হিসেবে গণ্য করতে চেয়েছে। মে দিবসের ইতিহাস এবং তাৎপর্যকে মূছে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পহেলা মে কে Law day হিসেবে ঘোষণা করে। শ্রমিক দিবসের পরিবর্তে ‘Law day’ ঘোষণা করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক তাৎপর্যহীন একটি ছুটির দিন হিসেবে মে দিবসকে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা সবসময় চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

শ্রমিক ও শ্রম আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালানো সত্ত্বেও ১৮৮৬ সালের ঘটনাপ্রবাহ এবং শিকাগোর দন্ডিতদের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে এ ধরনের আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করছে দাবি আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। এ আন্দোলনের সুবাদে অনেক নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে, পুজিবাদীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে এবং বহু আন্দোলন ও সংগ্রামের জন্ম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সভ্যতার ইতিহাসে অনেক কলঙ্কজনক ঘটনার মধ্যে এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাস্তবতা। তারপরও মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য সভ্যতার দাবিদাররা নিত্য গলধগর্ম। পৃথিবীর কোথায় মানবাধিকার গেল, কোথায় নারীর স্বাধীণতা এবং কোথায় শ্যমিকদের অধিকার হরণ করা হলো তা নিয়ে খবরদারি করতে তারা সদা ব্যস্ত। পৃথিবীর ইতিহাস স্বাক্ষী- পাশ্চাত্য সভ্যতা যত যুদ্ধ, গণহত্যা, মরণাস্ত্র, ধ্বংসলীলা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে কোনো মধ্য যুগ, বর্বর যুগ তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি।

মহান শ্রমিক দিবসের প্রাক্কালে আমরা বিশ্বের অগণিত শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। শ্রমিকদের পবিত্র ঘাম যাতে বিশ্বময় যথার্থ মূল্যায়িত হয় সে কামনা করছি। আজ শ্রমজীবী অভিবাসীদের হয়রানি করার যে অভিযাত্রা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের সভ্য দেশসমূহে চলছে তার অবসান কামনা করে মানবতাবাদী বিশ্বসমাজ। বিশ্বের দেশে দেশে নির্যাতিত প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে, দেশের অগণিত শ্রমিক সমাজের সাথে যথাথ আচরণ যাথে হয় এবং শরীরের ঘাম আর চোখের পানি যাতে একাকার না হয় সে দিকে বিবেকবান সমাজের কাছে সকলের প্রত্যাশা।

আজ যে কৃষক চড়ামূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক কিনে ফসল ফলাতে গিয়ে নিঃস্ব, সর্বস্বাস্ত হচ্ছে সে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগী, মুনাফাখোরদের কবলে পরে তারা দিশেহারা। চালসহ কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাসে ক্ষমতাসীন সরকারকারসহ শাসকগোষ্ঠী খুবই পুলকিত। কিন্তু কৃষক ও মজুরের হাড্ডিসার শরীর দুর্বিসহ জীবন করো নজর কাড়ে না। কৃষি নির্ভর এ দেশের ৮০% মানুষ যেখানে কৃষিকে অবলস্বন করে বেঁচে থাকে সে দেশে এ বিপুল শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সর্বাগ্রে দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষকের ফসল বিক্রয়ে ইসলামের সুস্পুষ্ট বিধান রয়েছে তা জানা ও মেনে চলা খুবই দরকার। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপাত থেকে তারা রক্ষা পেতে পারে।

মূলত পাশ্চাত্য উপলব্ধির অনেক আগেই ইসলাম শ্রমিকের অধিকার যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করেছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, দূর্বলের স্বার্থ এবং অসহায়দের হক ফিরিয়ে দয়ার জন্য অনেক আগেই মানবতার মুক্তির কান্ডারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট্র মহামানব হযরত মোহাম্মদ (স:) যে বাণী বিশ্ববাসীর সামনে রেখে গেছেন; যার বাণী ও কর্মে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মহানবী (স:) বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি কোন শ্রমিক দ্বারা কাজ করিয়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ না করবে, কেয়ামত দিবসে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার বিরুদ্ধে বাদী হবেন।’ বোখারী শরিফ)

রাসুল (স:) বলেছেন, ‘মজদুর দ্বারা কাজ করালে মজদুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী আদায় করে দাও।’ (মেশকাত শরীফ)

নবী (স:) আরো বলেছেন, ‘দড়ি নিয়ে জঙ্গলে যাও এবং জ্বালানি কাঠের বোঝা পিঠের উপর বহন করে বিক্রি করো; তা দ্বারা আল্লাহ তোমার মান ইজ্জত রক্ষা করবেন তা ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা উত্তম।’ বোখরী শরীফ)

মে দিবসকে আমরা স্মরণ করছি কেবল মাত্র এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে আলোচনার জন্য শুধু নয় বরং আজকে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল ইস্যুকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি ও কল্যাণমূখী সমাধানের পথ খূজে বের করার জন্য। বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের জয় হোক, শ্রমের মাহাত্মে উদ্ভাসিত হোক মানুষের এই পৃথিবী।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠক।

ই-মেইল: sahmedosmani@gmail.com