সমালোচকরাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল: প্রধানমন্ত্রী

0
493
blank

জাতীয় ডেস্ক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁকে ঘিরে সমালোচনাই হত্যাকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিঃশেষ করতেই পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এরপর স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দিয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। গতকাল রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আগারগাঁওয়ে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর নির্মিত ৯ তলা ভবনে এই জাদুঘর আনা হয়েছে সেগুনবাগিচা থেকে। বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর প্রায় প্রতিটি কাজের সমালোচনা করা হয়েছে মন্তব্য করে অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে যে সময় তাঁকে দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা দেওয়া হয়নি। সেই বাহাত্তর সালে ফিরে আসার পর থেকে যারা সমালোচনা, সমালোচনা, লেখা…, আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই লেখালেখি, সমালোচনার মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্ট পঁচাত্তরের ঘটনা ঘটাবার যেন একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। ’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ওই রাতেই তাঁকে আটক করে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা। অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) তাঁর সারা জীবন রাজনীতি পরিচালনা করেছেন এবং একটা পরিণতিতে এনে দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সমস্ত ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেল। কেউ ঘোষক হয়ে গেল, একজন একটা বাঁশির ফুঁ দিল আর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নানা ধরনের কাল্পনিক ইতিহাস দিয়ে আমাদের মূল ইতিহাসকে বিকৃত করা হলো। ’ তিনি বলেন, ‘২১টি বছর একটি জাতির জন্য কম সময় নয়। অনেক পানি গড়িয়েছে। আমি তো বলতে পারি, পঁচাত্তরের পর যে ঘটনা, যে অপপ্রচার চলেছে—তাতে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছে। সত্যিকার ইতিহাস জানতে পারে নাই। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরই বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধীদের পদচারণ শুরু হয়। আর স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় আসার সোপান তৈরি করে দিয়েছিল যারা তখন তীব্র সমালোচনা আর লেখালেখি করেছিল তারা। ’ প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলিমকে বানিয়েছিলেন মন্ত্রী। সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে বিচার বন্ধ এবং কারাগারে বন্দি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল জিয়ার সময়ে। সেই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনরায় চালুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জিয়া। পঁচাত্তরের ঘটনার আগে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেছিলেন তাঁদের বোধশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তাঁদের বোধশক্তির এই অভাবটা আমার কাছে মনে হয় সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার। আজকে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেন, কত ভুল চিন্তা তাঁদের ছিল। ’ শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ কেবল ‘একটি পরিবারের ওপর আঘাত’ বলে ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু দিনের পর দিন যখন গেছে, তখন অনেকেই উপলব্ধি করেছেন, এটা কোনো পরিবারের ওপর আঘাত ছিল না, ক্ষমতা দখলের জন্য ছিল না। এটা ছিল একটা চেতনাকে ধ্বংস করা, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে নস্যাৎ করা। আরো বেশি করে সকলের কাছে প্রমাণিত হলো, যখন ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ” তখনকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর ধূম্রজালের মধ্যে ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর ও ছোট বোন শেখ রেহানার কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার কথা। তিনি বলেন, কেউ বাড়ি ভাড়া দিত না বলে এই বাড়ি, ওই বাড়ি দিন কাটিয়েছেন তাঁরা দুই বোন। এর পরও বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে না থেকে তাঁরা সেটিকে জাদুঘর বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশপ্রেমিক এবং ভালো নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই তাদের ইতিহাস জানতে হবে। তিনি বলেন, “আমি অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি, ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপে মুক্তিযোদ্ধারা গর্বভরে বলতে পারেন ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা। ’” পঁচাত্তরের পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে গিয়ে বহু নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের ছুরি মারা হয়েছে। সমাজে তারা নানাভাবে অত্যাচারিত-নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি জাতির পিতার ছবি প্রচার হতো না টেলিভিশনে। অনেকের ছবির মধ্যে যদি জাতির পিতার ছবিও থাকত তাহলে সেই ছবিকে কৌশলে ঢেকে প্রচার করা হতো, এমনকি আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখতেও দেখা গেছে। ’ তিনি বলেন, সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না। সত্যের শক্তি অনেক বেশি। আজকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ফিরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী জাদুঘর চত্বরে রক্ষিত ‘শিখা অম্লান’ প্রজ্বালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফলক উন্মোচনের পর পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখেন। সূত্র: বাসস