সরকারের উন্নয়নের দাবি, ধর্ষণের দায় কার?

0
817
blank
blank

ড. আবদুল লতিফ মাসুম: বিদ্বজ্জনরা এখন উন্নয়নের প্রশংসা ও প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ। দেশ এখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ অবস্থান করছে! চারিদিকে মহাউন্নয়নের বিপুল জয়ধ্বনি। সড়ক মহাসড়ক রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার ও ব্রিজে উন্নয়ন দৃশ্যমান। পদ্মা সেতুর এক-একটি পিলার উন্নয়নের এক-একটা প্রমাণ দিচ্ছে। কিন্তু এ নিদর্শনকে ম্লান করে দিচ্ছে প্রতিদিন প্রকাশিত ধর্ষণের খবর। বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসা ও প্রশস্তিতে অস্বস্তি যোগ হচ্ছে এই জঘন্য অন্যায় অপকর্মে। ক্রমাগত প্রশংসায় নাগরিক সমাজ যখন একরকম আবিষ্ট, তখন দু’দিন আগে বাংলাদেশের একজন ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিজীবী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের একটি সেমিনারে অপ্রিয় সত্য কথা বললেন। এমনকি, তিনি মন্তব্য করেন, ‘উন্নয়নের দাবি যাদের ধর্ষণের দায়ও তাদের।’ যারা দেশকে কাঠামোগতভাবে এগিয়ে নিতে চায়, জনগণকে নৈতিকভাবে পরিচালনার দায়ও অবশ্যই তাদের।

উন্নয়নের অপর নাম হচ্ছে ‘আধুনিকায়ন’। উন্নয়ন যখন করা হয় তখন অনিবার্যভাবেই প্রকাশ ঘটে আধুনিকায়নের। এই প্রকাশের মাধ্যম হলো প্রগতি। এর দু’রকম অর্থ- চিন্তাচেতনায় কথিত রক্ষণশীলতা পরিহার। যেমন : পুরনো চিন্তা ধারার লোকেরা ধর্মে-কর্মে বিশ^াস করে। আপনি যদি প্রগতিশীল হন অথবা প্রগতিশীল নামে পরিচিত হতে চান তাহলে নাকি নাস্তিক হতে হবে। বড় গলায় ধর্মের বিধি-বিধানকে গালি দিলে নামী ব্যক্তি হওয়া যায়। মুজিব আমলে কবি দাউদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘মোহাম্মদ তুখোড় বদমাশ, চোখেমুখে রাজনীতি।’ ওই সময়ে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার যখন দু’দশক পরে তারা ক্ষমতাসীন হলেন তখন আল্লাহ, রাসূলসহ, ইসলাম ও মুসলমানকে গালি দিয়ে ব্লগার গ্রুপ বেপরোয়া হয়ে উঠল। এ কারণে হেফাজতে ইসলামের উত্থান সহজ হয়েছিল। ‘তেঁতুল হুজুর’ আওয়ামী ছোহবতের পরেও পর্দা পুশিদার কথা বলায় খুব সমালোচিত হয়েছেন।

আওয়ামী রাজনীতির প্রযতেœ কথিত প্রগতিশীলরা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্ম ও ন্যায়নীতির কথা কৌশলে বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। যে বিষয়গুলো গোপন তা প্রকাশ করে লাজ-লজ্জা দূর করে দিচ্ছেন। এর ফলে ইভটিজিং বা বখাটেদের উৎপাতের মাত্রা মহামারীর মতো বেড়েছে। গ্রাম-গঞ্জে রক্ষণশীল বা নীতিবানদের হাত থেকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চলে গেছে আধুনিক যুগের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে। সেই সাথে যোগ হয়েছে মোবাইল ফোন তথা তথ্যপ্রযুক্তির অভিশাপ। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? সেই বিতর্ক রয়েই গেছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া’র মতো। ন্যূনতম শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান একটি জনশ্রেণী গড়ে ওঠার আগে মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার আমাদের ঐতিহ্য ও সামাজিক মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিয়েছে। একেই হয়তো লেখক যাযাবর বলেছিলেন ‘বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এখন এভাবে বলা যায়, ‘উন্নয়ন আমাদের দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে ঈমান ও জীবনবোধ।’ জোয়ারের সাথে যে আবর্জনা আসে সে সম্পর্কে সতর্ক না থাকলে উন্নয়ন হয়ে দাঁড়ায় নিছক ভোগ-বিলাস ও বস্তুপূজা।

‘দুনিয়াকা মজা লে লো, দুনিয়া তোমহারি ই হ্যায়’ অথবা ‘যতখুশি তত খাও’ অথবা ‘ইট, ড্রিংক অ্যান্ড বি মেরি’- এসব তো কোনো মানবজীবনের আদর্শ হতে পারে না। অথচ শাসকগোষ্ঠী কোনোরকম আদর্শের বা নীতিগত অবস্থান ছাড়াই ভোগের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে দেশকে। যাদের কাছে টাকাই সর্বস্ব, তারাই এমন করতে পারে। যে যেভাবে পারে দুহাতে লুটপাট করছে। আর আদর্শ, নীতিহীন ও ভোগসর্বস্ব লোকদের হাতে টাকা গেলে তারা কী করে? গত বছর একজন এমপি, অগাধ অর্থবিত্তের মালিক এক ব্যক্তির ছেলেরা এবং স্বর্ণের দোকানের উত্তরাধিকারীরা কী করেছিল সবার নিশ্চয় তা মনে আছে। ‘পাপে পাপ আনে, পুণ্যে আনে সুখ।’ এদের দ্বারা এক পাপের দুনিয়ারই সৃষ্টি হয়েছে। নারী নির্যাতন, সম্ভ্রমহানি এবং ধর্ষণ সারা দেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রে তথা গণমাধ্যমে এমন অসংখ্য দুঃসংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাংলাদেশে। এ সময়ে ২৭৬ জন নারী ও মেয়ে শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে আরো ১০ জনকে। ধর্ষণের শিকার ৭৩১ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য ও পরিসংখ্যান জানায়। এতে বলা হয়, নারী ও শিশুদের উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ-গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা প্রভৃতি বেড়েই চলেছে। এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই হাজার ৮৩ জন নারী ও শিশু নির্যাতন এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৩ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। সম্মেলনে আরো জানানো হয়, নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের হার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিগত ছয় মাসে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫৪ জন নারী ও শিশু। যৌন নির্যাতনের শিকার ৭০ জন। আর একসময়ে মারধরের শিকার হয়েছেন ১৪৭ জন।
যৌতুকের কারণেও অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন গৃহবধূ হত্যার শিকার হন। এ সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্যটি সবাইকে বিচলিত করছে তা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট মামলায় মাত্র তিন-চার শতাংশ অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি আয়েশা খানম অভিযোগ করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, এ ধরনের প্রায় সব পাশবিকতার সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সাথে শাসকদলের শিক্ষার্থীদের অসভ্য আচরণ উল্লেখ করা যায়। সিলেটে প্রকাশ্যে এক ছাত্রনেতার নৃশংসতায় বিচলিত হয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। কুমিল্লা সেনানিবাসে তনুর মর্মান্তিক মৃত্যুর কোনো হদিস মেলেনি। শাসকমহলের লোকেরা যে এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তার নিকৃষ্ট প্রমাণ ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরত হত্যাকাণ্ড। বরগুনার ঘটনাটিও নারীঘটিত। সেখানেও সন্ত্রাসীদের লালনপালনে আওয়ামী লীগের সংস্লিষ্টতা প্রমাণিত। সেজন্য মহিলা পরিষদের সভাপতি বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দূর করার পাশাপাশি দেশের রাজনীতির সংস্কারের কথা যখন বলেন, তখন তা গভীর বিবেচনার দাবি রাখে।

৯ জুলাই ইংরেজি দৈনিক‘ নিউ এজ’ এ প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনটিও গভীর উদ্বেগ বহন করে। এতে বলা হয়, ধর্ষণ বিশেষ করে শিশুদের বেলায় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এ মাসের প্রথম সাত দিনে গড়ে ছয়টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। শিশু অধিকার ফোরাম জানাচ্ছে, জুলাই মাসের প্রথম সাত দিনে ৪১টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৪৯৬ জন ধর্ষিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ছয়টি শিশু একাধিক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত হয়। এদের মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৪১টি শিশু ধর্ষিত হয়। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী পাঁচজন। শিশু অধিকার ফোরামের তরফ থেকে আরো বলা হয়, এগুলো শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন।

তাদের আশঙ্কা অপ্রকাশিত ঘটনার সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবেদনে আরো প্রকাশ পায় যে, উল্লিখিত সময়ে ২৭৬ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এদের ১০ জনকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যায়। প্রতিবেদনে বিগত চার বছরের একটি পরিসংখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় গত চার বছরে পাঁচ হাজার ২০০ মহিলা ও শিশু আক্রান্ত হয়। একই সময়ে তিন হাজার ৯৮০টি ধর্র্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু অভিমত ব্যক্ত করেন, এসব ঘটনায় নারীর অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। তারা নারী উন্নয়নের স্বার্থে নারীর প্রতি সহিংসতার শাস্তি বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান। প্রতিদিন সহিংসতার খবর আসছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বিগত ৫ জুলাই ঢাকা ওয়ারীর একটি নির্মাণাধীন ভবনের অষ্টম তলায় একটি শিশুর রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ জানান, শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের নেতারা অভিযোগ করেন, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিচারহীনতার প্রবণতা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বহীন মনোভাবের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশে এই ব্যাপক অবক্ষয়ের পেছনে যেমন ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তেমনি সমাজের গভীরে নৈতিক স্খলন এর একটি বড় কারণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে মূল্যবোধের ধস নেমেছে। তার প্রধান কারণ সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন হ্রাস এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন।

এ রকম দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত রাষ্ট্রের। মনীষী অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রকে নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করেছেন। নাগরিকদের নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র তথা সরকার সমাজ ও রাজনীতিকে সে পথে ধাবিত করবে- এটাই কাম্য। কিন্তু যেখানে সরকারের সার্বিক কার্যক্রম দুর্নীতি দ্বারা আবিষ্ট এবং আদিষ্ট সেখানে সুশাসনের বাস্তবতা কতটা কার্যকর, তা ভেবে দেখার বিষয়। সরকার ‘উন্নয়ন’ বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে- কাঠামোগত দৃশ্যমান স্থাপনা। সুশাসনের কোনো দৃশ্যমান নমুনা প্রদর্শনে তারা ব্যর্থ। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান পিলার দেশের জনগণের নৈতিক উন্নয়নের ধারক নয়। সেটি অন্য কিছু। কাঠামোগত উন্নয়নের দায় যদি সরকারের থাকে, তাহলে তার নৈতিক উন্নয়নের দায়ও প্রধানত তাদের।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

[সূত্র: নয়া দিগন্ত]