শাহীন করিম:
একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা, সাত মাস আগে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব প্রতিবাদ আন্দোলন, নানা আশ্বাসের ফুলঝুড়ি কিংবা পরামর্শ কোনো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না রাজধানীর সড়কে মৃত্যুর মিছিল। অব্যাহত নৈরাজ্যের কারণে সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। প্রায় প্রতিদিনই নিহতের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে একেকটি নাম। সর্বশেষ এ তালিকায় যোগ হলো আরেকটি নাম-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী (২০)। চলমান ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহের মধ্যেই সড়ক আইন মেনে চলার পরও ঘাতক বাস কেড়ে নিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সক্রিয় এই ছাত্রের প্রাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া বাসচালক ও তাদের গডফাদারদের কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতির উন্নতি করতে যাদের কাজ করার কথা তারা নিষ্ক্রিয় থাকলে সড়কের অরাজকতা থামানো যাবে না। বাস দাঁড়ানোর জায়গা আছে কিন্তু সেখানে দাঁড়ায় না একটি বাসও। যারা এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করেন বা সুষ্ঠু করতে কাজ করেন তারাও এ থেকে লাভের গুড় খেতে ব্যস্ত। তাই সরষের ভূত সরানো না গেলে এই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয়।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে প্রগতি সরণির নদ্দা বাসস্ট্যান্ড ও যমুনা ফিউচার পার্কের মাঝামাঝি স্থানে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন বিইউপি ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পার হওয়ার সময়ই ঘাতক বাসটি তাকে চাপা দেয় বলে সহপাঠী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। একজন ছাত্রের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সড়কে নেমে আসেন বিইউপি, নর্থ সাউথ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, তিতুমীর কলেজসহ আশপাশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আট দফা দাবিতে বিকেল পর্যন্ত গোটা এলাকার সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তারা।
এভাবে একে একে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। এরপর কে? সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আবরার আহমেদ চৌধুরীর সহপাঠীদের প্রশ্ন এটা। আবরারের সহপাঠীরা জানতে চেয়েছেন এটা ‘কয়লার রাস্তা না রক্তের রাস্তা’। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কে জেব্রা ক্রসিংয়ের মধ্যে আবরারের রক্তের দাগের দুই পাশে দুইজন ছাত্র শুয়ে প্রতিবাদ করেন। একজনের পাশে প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘নিজের সিরিয়ালের অপেক্ষা করুন’। আরেকজনের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘আর কত প্রাণ নিবি’। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন মা-বাবা। মায়ের হাত ধরে ছেলে আর বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল মেয়ে ফাইজা তাহমিনা সূচি। এ সময় একা যেতে পারবে জানিয়ে বাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় ১০ বছরের কন্যাশিশুটি। রাস্তাটুকু প্রায় পারই হয়ে গিয়েছিল সে, ঠিক তখনই পেছন থেকে শিশু সূচিকে পিষে ফেলল বেপরোয়া একটি বাস। হতবিহ্বল চোখে নির্মমতম দৃশ্য দেখেন বাবা-মা। এভাবে দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিনই কারো না কারো জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’ নামক দানবের হাতে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ২১ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বুয়েটের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে আট হাজার। আর পুলিশের তথ্য বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, গেল বছর ৫ হাজার ৫১৪ দুর্ঘটনায় সড়কে নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ২২১ জন। আগের বছর ৫ হাজার ৯৭৯ দুর্ঘটনায় সড়কে ঝরেছিল চার হাজার ৩৯৭ প্রাণ। পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানী থেকে যানজট নিরসনে, শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গত সাত মাসে রাজধানীতে পঞ্চমবারের মতো শুরু হয়েছে ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ। সবশেষ গত রোববার কারওয়ান বাজারে ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ উদ্বোধন করেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক চাই নামে ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলনের পর ঘন ঘন ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করছে পুলিশ। কিন্তু রাজধানীর সড়কের দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন নেই বলে জানান যাত্রী ও পথচারীরা। যথারীতি মাঝ সড়কে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে গণপরিবহনের চালক-হেলপাররা। পুলিশের সামনেই বেপরোয়া গতিতে চালানো হচ্ছে বাস। কোনো নিয়মনীতি না মেনে যেখানে সেখানে থামানো হচ্ছে বাস। সড়কের নৈরাজ্য ও বেপরোয়া বাসচালকদের ঠেকাতে ট্রাফিক পুলিশ ততটা মনোযোগী নন বলেও অনেক যাত্রীর অভিযোগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ খতিয়ে দেখা হয়েছে। তার মধ্যে গাড়ি চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোকেই প্রধান হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেখা যায় অধিকাংশ গাড়ি চালকের লাইসেন্স কিংবা অভিজ্ঞতা এবং ড্রাইভিংয়ের যথেষ্ট জ্ঞান নেই! অধিকাংশ গাড়িচালক নেশাগ্রস্ত! অনেক সময় হেলপারকেও চালকের আসনে বসিয়ে দেয়া হয়। আর সড়কে কে কাকে ওভারটেক করে আগে এগিয়ে যাবে গাড়ি চালকদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা তো আছেই। ওভারটেক করা নিষেধ করা সত্ত্বেও মানতে নারাজ বেপরোয়া গাড়িচালকরা। বরং গতি বাড়িয়ে অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে গাড়িচালকরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ সাইফুন নেওয়াজ বলেন, যারা আইন প্রয়োগ করছেন তারা যেমন গণপরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তেমনি যারা আইন তৈরি করছেন তারাও এই জায়গা থেকে সুবিধাভোগী। তাই কেউ বিষয়টির সমাধান করতে চাচ্ছেন না। নিয়োগপত্রের মাধ্যমে চালকদের নিয়োগ দিলে এবং রুট ঠিক করলে এই সমস্যার উত্তরণ অনেকটাই সম্ভব। তার মতে ঢাকার বুকে সড়কে অকালে যেভাবে প্রাণ ঝরছে তা ঠেকাতে আরো প্রয়োজন বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন।
গত বছরের ৩০ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজিব নামে দুই শিক্ষার্থী। জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালকের প্রতিযোগিতার বলি হতে হয়েছে এ দুই শিক্ষার্থীকে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন গোটা ছাত্রসমাজ। দেশে প্রথমবারের মতো ঘটে যেন কিশোর বিদ্রোহ। ঘাতক চালকদের বিচারসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা সড়ক অবরোধ করেন খুদে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন গোটা দেশের ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শিশু শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন ও সড়কে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা থেকেও কেউ শিক্ষা নেয়নি বলে মনে করেন অধিকাংশ যাত্রী-পথচারী। তাদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন হত্যার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বেপরোয়া, অদক্ষ গাড়িচালক ও চলাচলের অযোগ্য রাস্তার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। সড়কে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যু নিছক কী দুর্ঘটনা নাকি হত্যা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে সর্বসাধারণের মনে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। এখনো ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসগুলো আগের মতোই এলোপাতাড়ি পার্কিং করে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে, বাসের গেট বন্ধ রাখা হচ্ছে না, বাসের ভেতরে চালকের ছবি ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি ঝুলিয়ে রাখা হয়নি। এখনো বেপরোয়া গতিতেই চলছে গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়িগুলোও রাস্তার পাশে যত্রতত্র পার্কিং করা হচ্ছে।
[মানবকণ্ঠ]
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.