১৪ ই ফেব্রুয়ারী: বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নয়, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস

0
1139
blank
blank

শিব্বির আহমদ ওসমানী: সময়টা ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দী মুক্তি ও জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে ছাত্র জমায়েত। সকাল থেকেই বিভিন্ন হল থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সমবেত হতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু শ্লোগানে কম্পিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও আসে পাশের এলাকা।
এক পর্যায়ে কয়েক হাজার ছাত্র ছাত্রীর একটি মিছিল স্মারকলিপি প্রদান করতে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে যায়। মিছিলটি যখন হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছে ঠিক তখনই আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে থাকা পুলিশ বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মিছিলে হামলা করে। লাঠি, টিয়ারগ্যাস, জল কামান, গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চারপাশ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ওই জমায়েত পরিণত হল বুট ও বুলেটে-দমিত জনতার এক বিরাট প্রতিরোধে। ওই দিন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালীসহ সারাদেশে প্রাণ দেয় ১০ জন।
সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ চেতনার দিন। সে থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
পটভূমি : ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। অনেকটা নীরবেই রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের স্বৈরশাসন মেনে নেয়। কিন্তু ছাত্ররা এ সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি। তাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে। ২৪ মার্চ কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াই।
পাকিস্তান পর্বে পূর্ববাংলার ছাত্রদের প্রধান দাবি ছিল একটি সুলভ, সার্বজনীন, বৈষম্যহীন, বৈজ্ঞানিক, উৎপাদনমূখী, জাতীয় ও গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশের আপামর জনগণের উদ্দেশে ১১ দফা প্রণয়ন করেছিল। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরপরই তার শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে।
সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচন-কে ভিত্তি ধরে প্রণীত এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবসে এ শিক্ষানীতি বাতিল করার পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত হয়। ১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরতা অভিযান চলে। দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়।
এ সংগ্রামকে প্রতিরোধ করতে সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে গ্রেপ্তার করলে ছাত্ররা আরো ফুঁসে ওঠে। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এবার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি হাতে নেয়। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩।
১৪ ফেব্রুয়ারি জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালীদের রক্তে রাঙা হলো রাজপথ। ফাগুনের ওই দিনটি আরও একগুচ্ছ শিমুল ফুল ফোটালো রাস্তার কালো পিচে। একটা আপোসহীনতার প্রদীপ জ্বলে ওঠলো চেতনায়। অধিকার আদায়ের দাবির স্বর হয়ে ওঠেলো আরও জোরালো।
অধিকারের রক্তিম ফুল দলিত ভ্যালেন্টাইনের পায়ে : দেশে যখন জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম দানা বাঁধতে শুরু করেছিল তখন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী জাতির চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর আগ্রাসনসহ তারা চেয়েছিল আমাদের উপর বিজাতীয় ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে। ঠিক তেমনিই পার্লামেন্টারি স্বৈরশাসকদের আমলে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’-এর চেতনাকে ধ্বংস করতে উদ্যত আজকের শাসক ও ব্যবসায়ী শ্রেণী।
সামরিক স্বৈরাচারের কয়েক বছর না যেতেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে পালনের জন্য ইনতেজাম শুরু হয়ে গেল। শফিক রেহমান সম্পাদিত যায়যায়দিন পত্রিকার হাত ধরে প্রেম-ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক সম্পর্ককে অতিপ্রাকৃত বিষয়ে পরিণত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়।
বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন শো, লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার, সিনেমা, নাটক, যাত্রা, অশ্লিল নৃত্যের সিডি, ইন্টারনেটে পর্ণগ্রাফির ছড়াছড়ি, এফএম রেডিও-র মধ্যরাতের অশ্লিল অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিকৃত যৌনতা-অশ্লীলতার চর্চা যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে পরিণত হয়েছে। আর ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপনের সংস্কৃতি ঠিক এ জোয়ারকেই জোরদার করছে।
কিন্তু তরুণদের অনেকেই এই জোয়ারে ভাসতে চান না। তারা জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনসহ লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে এই লড়াই চালিয়ে যেতে চান।
ভোট কিংবা সংস্কার নয়, আসুন, গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠণে অংশগ্রহণ করি!
এরশাদের পতন ঘটিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন ছিল শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি সংস্কার মাত্র। এতে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার পোশাক বদল হয়েছে মাত্র। ফলে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তাদের তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট শাসক শ্রেণী দোর্দ-প্রতাপেই ক্ষমতায় রয়েছে। এতে বিপ্লব হয়নি, শাসক শ্রেণী ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়নি, শ্রমিক-কৃষক-জনগণের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণেই স্বৈরাচারী এরশাদ আজ পুনর্বাসিত হয়েছে, সংসদীয় ব্যবস্থা উন্মোচিত হয়েছে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র রূপে। শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গণে চলছে খুনোখুনি, স্বৈরশাসন। আজ ছাত্র-যুব সমাজকে দেশপ্রেমিক, জাতি ও জনগণের সেবক হিসাবে গড়ে না তুলে, নৈতিক অবক্ষয়ের চরমে ঠেলে দেয়ার সবরকম আয়োজন চলছে। এ পরিস্থিতিতে উত্তরণের পথ ভোট বা সংস্কার নয়-এ কথা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। আজ কোটি কোটি বঞ্চিত জনগণের স্বপ্ন পুরণের একটিই পথ-বিপ্লব। এদেশ, জাতি ও জনগণ মুক্তি পায় নি; কিন্তু তার মুক্তির আকাঙ্খা কখনো দমে নি। তার লড়াই কখনো থামে নি। জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনসহ লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে এ লড়াইকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকেই।
আসুন, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে আওয়াজ তুলি:
সংসদীয় স্বৈরাচার নিপাত যাক, স্বাধীনতা-গণতন্ত্র মুক্তি পাক!
শিক্ষার উপনিবেশিকীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, দলীয়করণ-ফ্যাসিকরণ রুখে দাঁড়ান!
‘ভ্যালেন্টাইন’ সংস্কৃতিসহ অশ্লীলতা, যৌনতা ও নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধে গড়ে তুলুন!

লেখক: তরুন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও উদোক্তা।

www.facebook.com/ShibbirAOsmani