রাবি: আগের দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মীজান উদ্দিনকে লাঞ্ছিত করেন। বৃহস্পতিবার ভিসির কার্যালয়ে ঢুকে তাকে চপেটাঘাত করেছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। এ সময় সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অনৈতিকভাবে পদ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়োগের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুর একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মীজান উদ্দিনের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যান।
এ সময় তারা ভিসিকে চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবির মধ্যে রয়েছে- দীর্ঘদিন বাস বন্ধ থাকায় যে টাকা সাশ্রয় হয়েছে তা পরিবহনের উন্নয়নে ব্যয় করা, ঝড়ে যেসব গাছ পড়ে গেছে তা বিক্রি করে উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা প্রভৃতি।
এ নিয়ে ভিসির সঙ্গে প্রতিনিধি দলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। এক পর্যায়ে ভিসিকে চড় মারেন ডাবলু সরকার। এ সময় ডিন হাবিবুর রহমানকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে যান।
এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এর আগে একই দাবিতে গতকাল বুধবার দুপুরে রাজশাহী-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ভিসির দপ্তরে এসে ভিসিকে লাঞ্ছিত করেন।
এছাড়া গত মার্চ মাসের মাঝের দিকে ডাবলু সরকার ভিসির দপ্তরে এসে টেবিল চাপড়ে তাকে হুমকি দিয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে একটার দিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, সহ-সভাপতি শাহাদাত হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জেডু সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা লোটন সরকারসহ ১৫-১৬ জন আওয়ামী লীগ নেতা কোনো পূর্বানুমতি ছাড়াই ভিসির দপ্তরে প্রবেশ করেন।
এ সময় তারা দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ না দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের দ্রুত কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।
ভিসির দপ্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান, শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনন্দ কুমার সাহাসহ কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা কবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হবে জানতে চাইলে ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি ও প্রক্রিয়া মেনে নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানান।
এ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতারা দ্রুত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেয়ার জন্য উচ্চস্বরে কথা বলতে শুরু করেন। এতে দপ্তরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহাদাত হোসেনকে হাত ধরে শান্ত হতে বললে আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষকদের মারতে তেড়ে আসেন।
এক পর্যায়ে ডিন হাবিবুর রহমানকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। সেটি ঠেকাতে গেলে ভিসি চপেটাঘাত করেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ সময় নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ নেতারা ভিসিসহ শিক্ষকদের গালিগালাজ করেন এবং এর এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রউপদেষ্টা অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিন মাতিন ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে লাঞ্ছিত করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এমন পরিস্থিতিতে ভিসি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না বললে আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
পরে এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘শিবিরের হাতে নিহত ছাত্রলীগকর্মী ফারুকের বোনের চাকরি স্থায়ী করা, আহত ছাত্রলীগ নেতা মাসুদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করাসহ আমাদের কিছু দাবি নিয়ে আমরা ভিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম।’
তিনি জানান, ‘কিন্তু ভিসি বলেছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলবেন না। এ সময় নেতারা উঠে আসতে গেলে আমাদের সহ-সভাপতিকে এক শিক্ষক হাত ধরে টান দেন। এতে নেতাকর্মীরা ক্ষিপ্ত হলে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এর বেশি কিছু নয়।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতারা কোনো পূর্বানুমতি ছাড়াই দুপুরে ভিসির চেম্বারে প্রবেশ করেন। তারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের যেভাবেই হোক চাকরি দেয়ার দাবি জানান।’
তিনি বলেন, ‘এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতারা শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।’
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দপ্তরে এভাবে যখন-তখন পদের কথা বলে নেতাকর্মীরা প্রবেশ করে যা ইচ্ছে বলে ও করে যাবেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সম্মানহানী বলেও জানান অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেন।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যাললেয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘এ ঘটনা খুবই হতাশাজনক। সন্ধ্যায় আমাদের একটি মিটিং আছে। সেখানে পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক কেএম মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালের মত একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনায় আমরা খুবই লজ্জিত।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী চলে। তারা নিয়োগ দেওয়ার কে?’