Home মতামত শিশু হত্যা: সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি

শিশু হত্যা: সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি

931
0

মো. রহমত উল্লাহ : আমরা দিন দিন পরিণত হচ্ছি দানবে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। গত বছর সিলেটে শিশু রাজনকে দিনদুপুরে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় অনেক লোকের সামনে। তার বিরুদ্ধে ছিল তুচ্ছ চুরির অপবাদ। রাজন হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনায় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা হয় ১২ বছরের শিশু রাকিবকে। রাকিবকে অত্যন্ত জঘন্য ও পৈশাচিকভাবে মলদ্বারে পাম্পিং পাইপ ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ একটা ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর যেখানে নির্যাতন কমে আসার কথা, সেখানে দানবরা আরও প্রবল বিক্রমে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম তাদের এক গবেষণায় বলেছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৯১টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর দু’মাসে মৃত্যুর মিছিলে আরও যোগ দিয়েছে ৫৫টি কচি প্রাণ। ২৪৬টি শিশুর ২১ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়, আর ৩১ জনকে হত্যা করা হয় অপহরণের পর। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এ চার মাসে শিশুহত্যার গ্রাফ যে নিুমুখী নয়, তা বলাই বাহুল্য।
দেশে শিশুর সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, মনুষ্য সন্তানের জন্মের পর থেকে বয়সন্ধিকালের মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপকে শিশু বলে। তবে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতি অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সব ছেলেমেয়েকে শিশু হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সর্বশেষ হিসাবমতে বাংলাদেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। যে দেশের জনসংখ্যার এত বড় একটি অংশ শিশু, সেদেশে শিশুদের জন্য একটি বিশেষ নীতির ঘোষণা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে শিশুদের সমতা, নৈতিকতা, অবৈতনিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪)-এ শিশুর অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
দেশে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত আইন নেই, তা নয়। পর্যাপ্ত আইনের পাশাপাশি রয়েছে শাস্তির সুস্পষ্ট বিধান। আরও আছে শিশু নির্যাতন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য বিশেষ আদালত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০১৩ অনুসারে ১৮০ দিনের মধ্যে যে কোনো শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। অন্যথায় বিচারককে হাইকোর্টে জবাবদিহিতার মতো কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এছাড়াও রয়েছে নির্যাতিত শিশুর মামলা চলাকালীন সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা। তাছাড়া কোনো নির্যাতিত শিশুর অভিভাবককে মামলা পরিচালনা করতে নিজস্ব কোনো উকিল নিয়োগ করতে হয় না, পাবলিক প্রসিকিউটররাই মামলার ওকালতি করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ২০১০ সালে ঢাকায় ঘাতকদের হাতে নিহত শিশু সামিউলের অভিভাবককে পাঁচ বছরেও আমরা কি কোনো বিচার নামক সান্ত্বনা উপহার দিতে পেরেছি? না, পারিনি। তবে কী লাভ এত শত আইনের বোঝা বাড়িয়ে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এমন হাজার হাজার মামলা বিভিন্ন আদালতে ঝুলে রয়েছে নানা জটিলতার কারণে। যার ফলে গড়ে উঠেছে বিচারহীনতার দীর্ঘ সংস্কৃতি। নির্যাতনের পর শিশুর বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। যতটুকু সম্ভাবনা থাকে তাতে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মামলার রায় পেতে পেতে অভিভাবকরা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। তাছাড়া ক্ষমতাসীনদের চাপে পড়ে অধিকাংশ ভুক্তভোগী আদালতপাড়ার দিকে পা বাড়ানোর সাহস দেখায় না।
সচেতনতার অভাবে বা অজ্ঞাতসারে শিশুর সবচেয়ে আপনজনরাও নানাভাবে ঘটিয়ে চলেছে নির্যাতন। আমরা আমাদের সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা করি সর্বোচ্চ একাডেমিক সাফল্য। প্রতিটি পরীক্ষায় তার কাছে আমাদের প্রত্যাশার পারদ শিখরে পৌঁছে যায়। আর যখন শিশুটি প্রত্যাশিত ফলাফল করতে ব্যর্থ হয় তখন অভিভাবকরা তার ওপর খড়গহস্ত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে নির্যাতন শরীর পর্যন্ত পৌঁছায়।
শিশু অধিকার রক্ষায় দেশে ভূরি ভূরি আইন হয়েছে। হয়েছে অসংখ্য সভা, সেমিনার আর সিম্পোজিয়াম। কিন্তু বন্ধ হয়নি শিশুদের প্রতি অযাচিত মানসিক চাপ আর নির্যাতন। এখনই সময় শিশুদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমরা যদি শিশুদের উপযোগী সমাজ গড়তে না পারি তবে বলতে হবে রাজনরা মরে ভালোই করেছে, অন্তত জীবনের পদে পদে দানবদের রক্তচক্ষু আর তাদের দেখতে হবে না। ওপারে ভালো থাকুক রাজন, রাকিব, সামিউলরা।
মো. রহমত উল্লাহ : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Previous articleচাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই পুলিশকে চাপা দিয়ে চলে গেল ট্রাক
Next articleওয়ান-ইলেভেনে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে: হানিফ