Home জাতীয় সিলেট নগরীতে ‘হাফপ্যান্ট বাহিনী’ আতংক

সিলেট নগরীতে ‘হাফপ্যান্ট বাহিনী’ আতংক

467
0

তুহিনুল হক তুহিন: ‘হাফপ্যান্ট বাহিনী’ সিলেটে একসময় আতঙ্কের নাম ছিল। সিলেটজুড়ে হাফপ্যান্ট বাহিনীর নামে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল সংঘটিত ডাকাত দল। ডাকাত সরদার মজিদের নেতৃত্বে এ বাহিনী মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল। মজিদের পুত্র-জামাতা সকলেই ছিল সে বাহিনীর সদস্য। হাফপ্যান্ট পরে প্রায় প্রতি রাতেই তারা বেরিয়ে পড়তো লুটের মিশন নিয়ে। তবে ‘র‌্যাব’ প্রতিষ্ঠার পর ভিত কেঁপে ওঠে হাফপ্যান্ট বাহিনীর।

র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মজিদের জামাতা জমশেদ ও ছেলে আনু। তছনছ হয়ে যায় তাদের সাম্রাজ্য। স্বস্তি আসে জনমনে। নিজেকে গুটিয়ে নেয়া মজিদ ডাকাতও এক সময় মারা যায়। সিলেটবাসী ভুলতে বসেছিল হাফপ্যান্ট বাহিনীকে। তবে নতুন করে আবার যেন ফিরে এসেছে হাফপ্যান্ট বাহিনী।

‘ঐতিহ্যবাহী’ সে হাফপ্যান্ট পরেই সিলেটে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি ডাকাতচক্র। কখনো হাফপ্যান্ট কখনো আরো সংক্ষিপ্ত পোশাকে সিলেট নগরীর বাসিন্দাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে চাইছে তারা। গত দুই মাসে হাফপ্যান্ট বাহিনী বেশ কয়েকটি অভিযানে লুটে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। আর এসব ডাকাতির অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে শাহপরাণ থানা কেন্দ্রিক।

এমনকি বেপরোয়া ডাকাতদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছেনা শাহপরান থানা পুলিশ। তাহলে কি পুলিশ ডাকাতদের সাথে কৌশলে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি সম্প্রতি বালুচর এলাকায় বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটলে শাহপরান থানা পুলিশ এসব ডাকাতির ঘটনায় লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারত দূরের কথা এখনো পর্যন্ত ডাকাত দলের সদস্যদের চিহ্নত করতে পারেনি। যারা কারণে একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

স্থানয়ীরা অভিযোগ করেন- শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন থানায় নিয়োগ হওয়ার পর থেকেই একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এমনকি ওসি নিজেই ডাকাতদের প্রতিরোধের ঘোষণা দিলেও তা আর কাজ হচ্ছে না।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়- বেশির ভাগ ডাকাতির ক্ষেত্রেই মামলা বেশি দূর এগোয় না। এমনকি চূড়ান্ত প্রতিবেদনও জমা পড়ে না প্রায় ক্ষেত্রেই। এর পেছনের মূল কারণ হচ্ছে অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে না পারা। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরাই আরও বড় বিপদের ভয়ে অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে চায় না।

ফলে ডাকাতির ঘটনায় আটক হলেও প্রমাণ না থাকায় জামিনে বেরিয়ে আসে অভিযুক্তরা। জামিনে বেরিয়ে আসার পর এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে, আরও দুঃসাহসী অভিযান চালায়। সিলেটের জুয়েলারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত নেহার মার্কেটের আলোচিত হত্যাসহ ডাকাতি মামলায় আটক হওয়াদের সবাই এখন জামিনে বাইরে আছে।

এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগর রাতে সিলেট শহরতলীর শাহপরান থানার খাদিমনগরের বাহুবলে একই রাতে ব্যাংক কর্মকর্তার বাসাসহ ৩টি পরিবারে দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। এসময় ডাকাতরা প্রায় ৪ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে ঘটনার ২ মিনিটের মধ্যে টহলরত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও কোনো ডাকাতকে আটক করতে পারেনি।

বাহুবল এলাকার ১নং রোডের বি-বøকের ১২ নম্বর বাসায় (ইমরান ভিলায়) এ দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান- রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসার ভিতরে শব্দ শুনে জেগে উঠি। এসময় বাসার প্রধান ফটক ভেঙে ৮-১০ জনের হাফপ্যান্ট পরিহিত ডাকাতরা বাসার ভিতরে বেশ করে তাকেসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বেঁধে ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসায় লুটপাট চালায়। এসয় তারা ৫ ভরি স্বর্ণ, ১টি ল্যাপটপ, ৯ হাজার ২ টাকার প্রাইজবন্ড ও নগদ ৫ হাজার টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।

এছাড়াও একই সময় একই ফ্লাটের আরো দুটি পরিবারেও ডাকাতি করে হাফপ্যান্ট বাহিনী। ওই ভবনের ২য় তলার কলেজ শিক্ষার্থী ইমরানের বাসায় ডাকাতরা প্রবেশ করে একি কায়দায় ৮ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। এছাড়াও নীচ তলার বিশু নামের অপর এক ব্যক্তির কাছ থেকে ডাকাতরা মোবাইল ও নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে ঘটনার ২ মিনিটের মধ্যে টহলরত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও কোনো ডাকাতকে আটক করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়- গত বুধবার দিবা গতরাত সাড়ে ৩টার দিকে শাহপরান থানাধীন মেজরটিলা এলাকার সৈয়দপুরের দুটি বাসায় পৃথক হয়ে হানা দেয় আবারো নাগরিকদের আতংক হাফপ্যান্ট বাহিনীর ডাকাতরা। তবে ওই এলাকার দুটি পরিবারের সদস্যরা ডাকাতির ঘটনার বিষয়টি বুঝতে পারে সাথে সাথে তারা চিৎকার শুরু করেন। তাদের চিৎকারে হাফপ্যান্ট বাহিনীর ডাকাতরা ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে ওই সময় ওই এলাকা থেকে কোন টহল পুলিশ ছিলো না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে শাহপরান থানাধীন মেজরটিলা এলাকার সৈয়দপুরের উদয়ন ৯/১ এর বাসিন্দা শিপন চৌধুরী ও একই এলাকার সি-বøকের ৭নং বাসায় ডাকাতরা ডাকাতির চেষ্টা চালায়। গ্রিল কেটে প্রবেশ না করতে পারায় ডাকাতদলের সদস্যরা একটি রুমের জানালার গ্রিল কাটতে শুরু করলে বিষয়টি বুঝে ঘুম থেকে জেগে উঠেন বাসার বাসিন্দা শিপন চৌধুরী।

এরপর তার পরিবারের সদস্যরা চিৎকার শুরু করলে আশপাশ এলাকার মানুষ আসার পূর্বেই ডাকাতরা পালিয়ে যায়। একি ভাবে অপর একটি ১০-১২ জনের একটি ডাকাতদল একই এলাকার সি বøকের ৭নং বাসায় হানা দেয়। সেখানেও গ্রিল কাটা শুরু করলে বিষয়টি বুঝতে পারেন ওই বাসার এক গৃহিনী। তিনি চিৎকার শুরু করলে ডাকাতদলের সদস্যরা পালিয়ে যায়। ডাকাতদের ডাকাতির চেষ্টার ঘটনায় মেজরটিলা এলাকার সৈয়দপুরের উদয়ন ৯/১ এর বাসিন্দা শিপন চৌধুরী বাদি হয়ে শাহপরান থানায় সাধারণ ডায়রি নং-৭৩৪ দায়ের করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়- গত মাসে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক খসরু মো. সালাহউদ্দিনের বাসা উত্তর বালুচর ডি-বøকের ৬নং রোডের আমীন ভিলায় হানা দেয় ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল হানা দেয়। হাফপ্যান্ট পরিহিত মুখোশধারী ডাকাত দলটি পরিবারের সদস্যদের বেঁধে রেখে স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও অন্যান্য জিনিস প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট হয় এ দুই বাসা থেকে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর ভোরে হাফপ্যান্ট বাহিনী হানা দেয় নগরীর খাসদবীরের বন্ধন বি-১৭ নম্বর বাসার বাসিন্দা ফরিদ মিয়ার বাসায়। ওই দিনই ছিল তার মেয়ের বিয়ে। ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল ভোরে বাসার গ্রিল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে নববধূর গয়নাসহ প্রায় ৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা, মোবাইল ফোনসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয়।

প্রায় একই সময়ে একই এলাকার বন্ধন-এফ ১১ নম্বর বাসায়ও ডাকাতরা হানা দেয়। ওই বাসা থেকে প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকাসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় ডাকাত দল। দুটো ঘটনাতেই ডাকাত দলের পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। যুগল ডাকাতির এমন ঘটনা মাস দেড়েক আগেও। ৩১ জুলাই রাতে নগরীর পীর মহল্লায় পাশাপাশি দুটো বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

ঐক্যতান ২২১/৪ এর বাসিন্দা ফজলুল হক ও ঐক্যতান ২২১/৪-এর বাসিন্দা মুজিবুর রহমানের বাসায় হানা দিয়ে থেকে ১২-১৪ জনের ডাকাত দল ব্রিটিশ পাউন্ড, স্বর্ণালঙ্কারসহ ২০-২৫ লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয়। এর দিন চারেক আগে নগরীর পাঠানটুলায়ও ঘটে যুগল ডাকাতির ঘটনা। ডাকাতরা পাঠানটুলার মোহনা-১৯ এর বাসিন্দা প্রবাসী মতছির আলীর বাসা থেকে ৪০ হাজার টাকা, ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও চারটি মোবাইল ফোনসেট লুট করে নেয়। আর ব্যবসায়ী আবদুর রহিমের মোহনা ২৯/৩ নাম্বার বাসা থেকে লুটে নেয় নগদ ৭৫ হাজার টাকা ও ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার।

২২ জুলাই নগরীর সেনপাড়া এলাকার পুষ্পায়ন ১০২ নাম্বার বাসায় হানা দিয়ে বাসার মালিক ও ভাড়াটেদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে স্বর্ণালঙ্কারসহ ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নেয়। কয়লা ব্যবসায়ী জয়দেব চক্রবর্তীর বাসায় এ ঘটনাটি ঘটে। আন্ডারওয়্যার পরে ডাকাতরা তার বাসায় হানা দেয়। একই পোশাকের ডাকাতদল ৫ই আগস্ট রাতে হানা দেয় শহরতলির বালুচরের ফোকাস ১২ নাম্বার বাসায়। বাসার গ্রিল ভেঙে ভেতরে ঢোকা ১০/১২ জনের ডাকাত দলটি নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়।

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান বলেন- ইতিমধ্যে কয়েকজন ডাকাতকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আদালতে এদের জবানবন্দিও নেয়া হয়েছে। তারপরেও ডাকাতির ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। পুলিশ কিন্তু ডাকাতদেরকে গ্রেফতার করতে কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিটি এলাকার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।  পুলিশ আর জনগণ একসাথে কাজ করলে ডাকাতদলকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। ডাকাতদলকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশি তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে।

Previous articleগুডবাই দাঁড়িপাল্লা: টেক কেয়ার নৌকা
Next articleডেঙ্গু জ্বর আতঙ্কিত হওয়ার মতো রোগ নয়: স্বাস্থ্যমন্ত্রী