আমাকে সীমান্তের ওপারে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিলঃ ফরহাদ মজহার

0
541
blank
blank

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি। তিনি বলেন, সাদা পোশাকের কিছু লোক র‍্যাবের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। অপহরণকারীরা তাঁকে খুলনা-যশোর সীমান্তের দিক দিয়ে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।

আজ শনিবার রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার এসব কথা বলেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতারের দায়ের করা অপহরণ মামলায় আদালত গত বৃহস্পতিবার পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আদালত ফরহাদ মজহার ও তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পুলিশকে অনুমতি দেন। এরপর আজ গণমাধ্যমের সামনে আসেন তিনি।

ওষুধ কেনার জন্য নিচে নেমে অপহরণের স্বীকার হন দাবি করে এই কবি-প্রাবন্ধিক বলেন, ‘তিনজন লোক আমাকে ঘিরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে জোর করে তুলেই আমার চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে সময় আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করতে পারি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ যা কিছু অপহরণকারীরা করতে বলে-তাই আমি করি। যেখানে তারা ছেড়ে দেয় তা আমি চিনি না। আমি বুঝতে পারি তারা আমার ওপর নজরদারি করছে। তাদের নির্দেশমতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গাড়িতে উঠলে গাড়িতে তাঁরা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়। আমি মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়ি। শোরগোল শুনে জেগে উঠি। এর পর কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে আবার নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।’

ফরহাদ মজহার দাবি করেন, হত্যা করার জন্য বাস থেকে নামানো হচ্ছে ভেবে তিনি এ সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সাদা পোশাকের কিছু লোক র‍্যাবের দিকে বন্দুক তুলে শাসিয়ে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয়। তবে র‍্যাব রীতিমতো ছোটখাট যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাঁদের গাড়িতে ওঠায়। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো র‍্যাবের গাড়ি থেকে আমাকে নামানোর চেষ্টা করে।’

ফরহাদ মজহার আরও বলেন, অপহরণকারীরা তখনো এলাকায় থাকতে পারে ভেবে র‍্যাব তাঁকে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা-বিশ্রামের পাশাপাশি তদন্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা র‍্যাবের গাড়ির দুই দিকের রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে পথরোধ করে রেখেছিল। পরে র‍্যাবের গাড়িসহ তাঁকে এক জায়গায় নিয়ে বলা হয় সেটি অভয়নগর থানা।

পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমি ভিকটিম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জোর করে র‍্যাবের গাড়ি থেকে নামানো হয়। আমার সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি। একটি গাড়িতে আমাকে নিয়ে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে পুলিশ ঢাকার দিকে রওনা হয়।’

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি জীবিত ফিরে আসায় আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমি সারা জীবন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশে গুমের এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে, সকল মান-অপমান সহ্য করে হলেও বাংলাদেশে এ যাবৎ গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে সে ক্ষেত্রে আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে।’

জোরপূর্বক অপহরণের মতো মারাত্মক ও জঘন্য ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করে অভয় নগর থানার বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাকে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন ফরহাদ। তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেস কনফারেন্স করে আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। পুলিশের প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করলে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার হুমকি দেন। এতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই ডিবি তাদের অফিসে ডেকে নেয়। সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে পুলিশের প্রতিবেদনে সায় না দিলে সামাজিকভাবে আরও লাঞ্ছিত করা ও মামলা করার হুমকি দেয়। এরপর থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।

১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রসঙ্গে যা বললেন

আদালতে দেওয়া নিজের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে ঢাকার আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমাকে আমার পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। পরে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। ডিবি অফিসে হতভম্ব, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। আমি আদালতকে প্রচণ্ড বিভ্রান্ত অবস্থায় এইটুকু শুধু বলতে পারি যে, আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় অত্যন্ত নাজুক। আমার ভীতি ও ট্রমা এখনো কাটেনি। ডিবি অফিস আমাকে দিয়ে যা লিখিয়ে নিয়েছে আমি তাই আপনাকে দিচ্ছি। এরপর তাঁর (বিচারকের) অনুমতি নিয়ে তাঁর কক্ষের একটি সোফায় এলিয়ে পড়ি।’

মামলার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে এই সংবাদ সম্মেলন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাঁদের একজনের হয়ে কথা বলতে এসেছেন। ফলে আমার একার জন্য এখানে কথা বলতে আসিনি। আদালতে মাত্র মামলাটা যাচ্ছে। আদালতে সওয়াল-জবাব হবে। আইন প্রক্রিয়ায় যা হবে সেটা আমি মেনে নিবো।’ সব কথা তিনি আজকে বলে পরিষ্কার করতে পারবেন না বলে সাংবাদিকদের জানান ফরহাদ। তিনি বলেন, এর মধ্যে যাই কিছু হোক না কেন তিনি তার জন্য তৈরি আছেন।

গত ৩ জুলাই ভোরে বাসার কাছ থেকে অপহরণের হওয়ার অভিযোগ ও এর ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার হওয়া, এরপর অপহরণ মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরও গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি ফরহাদ মজহার।

পুলিশ বলছে, ফরহাদ মজহার অপহরণ হননি, তিনি স্বেচ্ছায় খুলনা গিয়েছিলেন। তবে ফরহাদ মজহারের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, গত ৩ জুলাই ভোর পাঁচটার দিকে শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ফরহাদ মজহার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামেন। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফরহাদ মজহার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোন করে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এ ঘটনায় রাজধানীর আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা করেন।