আহলান সাহলান মাহে রমজান

0
1313
blank
blank

মো: তৌহিদুল ইসলাম: আল্লাহ তায়ালার বরকত ও করুণাধারায় আমাদের জীবনগুলোকে সিক্ত করতে পবিত্র মাহে রমজান ফিরে এলো আরেকবার। রমজানের প্রতিটি দিনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অগণিত বান্দাহ প্রভুর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং বৈধ আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করে সাক্ষ্য দেয় যে, কেবল আল্লাহ তায়ালাই তাদের প্রভু আর একমাত্র তার সন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি।

এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে এত বেশি বরকত লুকিয়ে আছে যে, এই মাসে করা নফল কাজগুলো ফরজ কাজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)। ‘রমজান এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, সৎপথে চলার পথ সহজ হয়ে যায়, শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়’ (বুখারি ও মুসলিম)। ‘অন্যায় ও পাপকাজ থেকে দূরে থাকতে রোজা ঢালস্বরূপ। অতএব, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা একিন ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে রাখবে তার অতীত ও বর্তমানের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (বুখারি)। কদরের রাতে যে ব্যক্তি কিয়ামের মাধ্যমে রাত কাটিয়ে দেবে তাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে শুধুমাত্র এই শর্তে যে, আল্লাহ তায়ালার বাণী আর ওয়াদাকে তারা সত্য মনে করবে, বান্দাহ হিসেবে নিজের সব দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করবে (বুখারি)।
এই মাস নিঃসন্দেহে আত্মমর্যাদা ও বরকতের মাস। গতানুগতিকতার স্বাভাবিক প্রবাহে যারা এ মাসকে অতিবাহিত করবে, এর মর্যাদা ও বরকত তাদের জন্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বৃষ্টির পানি সবার জন্যই রহমত। বৃষ্টিতে একটি গ্লাস রাখলে যে পরিমাণ পানি ধরবে তা কখনোই একটি পুকুরের সমান হবে না। আবার একটি বিস্তীর্ণ মরুভূমি বা অনুর্বর ভূমিতে পড়লেও ভূমি তা থেকে উপকৃত হতে পারে না। কিন্তু সেই পানি উর্বর ভূমিতে পড়লেই ফসল জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি রমজান থেকে কে কতটুকু ফায়দা হাসিল করবে তা নির্ভর করবে নিয়ত, সঠিক পরিকল্পনা, কর্মপ্রচেষ্টা আর আমলের ওপর। রাসূল সা: বলেন, কেউ তার দিকে এক হাত অগ্রসর হলে আল্লাহ তার দিকে দুই হাত অগ্রসর হন। তার দিকে যে হেঁটে যায়, আল্লাহ তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হন (মসুলিম)। রোজা আসে রোজা যায় তবুও কারো কারো তহবিল শূন্যই থেকে যায়, এমন দুর্ভাগাদের কাতারে আল্লাহ যেন আমাদের না রাখেন। রাসূল সা: বলেন, অনেক রোজাদার আছেন যাদের ভাগ্যে ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া আর কিছুই জোটে না, অনেকে সারা রাত যাপন করেন, কিন্তু তা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই হয় না (মুসলিম)।
এই মাস আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিতৃপ্তি অর্জনের মাস, ঈমানের সংস্কার করার মাস। আত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনার মাস, নফসের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মাস, কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার মাস, সর্বোপরি মানুষ হওয়ার মাস। মুসলমানরা এ মাসের অপেক্ষায় থাকেন অধীর আগ্রহে।
রমজানে অর্জিত হয় তাকওয়া, বাস্তবায়ন হয় আল্লাহর নির্দেশমালা। শাণিত হয় ইচ্ছা। অর্জিত হয় ঐক্য, মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব। অনুভব করে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা। এটি ত্যাগ, বদান্যতা আর আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার মওসুম। যে ব্যক্তি রোজা রাখবে তার রূহ পবিত্র হবে। হৃদয় নরম হবে। অনুভূতিগুলো শাণিত হবে, আচরণগুলো বিনম্র্র হবে। এ মাসে মুসলমানরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার অনুভূতি অর্জন করে। এ মাসে একজন মুসলিম প্রশিক্ষণ নেয় আত্মদানের।
মহান আল্লাহ তায়ালা এ মাসে অসীম আগ্রহে মানবতাকে ধন্য করেছেন, মানবজাতিকে পথ প্রদর্শনের সম্পূর্ণ প্যাকেজ (কুরআনুল কারিম) দান করেছেন। কোনটি সঠিক আর কোনটি নয় তা পরখ করার জন্য ভ্রান্তি-বক্রতা-বিকৃতিমুক্ত এক কষ্টিপাথর আমাদের দান করেছেন। রোজা রাখা কিংবা কুরআন তেলাওয়াত করার জন্য এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব¡ হয়নি বরং পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মহান ঘটনার কারণে এ মাসের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হয়েছে। তাই শুধু তেলাওয়াত নয় বরং কুরআনকে অর্থসহ বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান সেই মাস যে মাসে মানবজাতির পথ প্রদর্শনের নিদর্শনগুলো ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কুরআন নাজিল হয়েছে। অতএব যে এই মাস পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
নিঃসন্দেহে কুরআন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আর যে নেয়ামত যত বেশি মূল্যবান, তার হক আদায় করার দায়িত্বও তত বেশি। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যপানে পৌঁছবার জন্য যে কিতাব সঠিক পথ প্রদর্শন করে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সেই কিতাবের বাহক হিসেবে আমাদের দায়িত্বও অনেক বেশি ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ জন্য প্রতিনিধি হিসেবে ১. আমাদের নিজেদের এর প্রদর্শিত পথে চলা এবং নিজের মন, চিন্তা, কর্ম, চরিত্র ও তৎপরতাকে এর ছাঁচে ঢেলে সাজানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো এবং ২. এই হেদায়েত শুধু নিজের ব্যক্তিজীবনে নয় বরং তা সবার কাছে পৌঁছানো, এর প্রদর্শিত পথে চলার জন্য আহ্বান জানানো ও অন্ধকার পথগুলোকে আলোকিত করা জরুরি। দ্বিতীয় দায়িত্বটি প্রথম দায়িত্বের অনিবার্য দাবি। কারণ দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন ছাড়া প্রথম দায়িত্ব পালন পূর্ণাঙ্গ হয় না। আল্লাহর ঘোষণা- ‘তোমার প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব আর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এবং তাদের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা কর’ (সূরা মুদ্দাসসির : ২-৩)। মুসলিম উম্মতের সৃষ্টি মূলত এ কারণেই করা হয়েছে।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য বা ফলাফল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। অর্থাৎ রোজা রাখার মাধ্যমে তাকওয়া বা খোদাভীতির সেই গুণই অর্জন করতে হবে যার ফলে কুরআন নির্দেশিত পথে চলা সহজ হয়ে যায় এবং কুরআনের হক আদায় করে যথাযথভাবে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা যায়। তাকওয়া এমন একটি জিনিস যার মাধ্যমে সব সমস্যা মোকাবেলা করার একটি পথ পাওয়া যায়। তাকওয়ার মাধ্যমে রিজিকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়, দ্বীন ও দুনিয়ার কাজ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন। মুত্তাকিদের জন্য এমন সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, ‘যার প্রশস্ততার মধ্যে পুরো পৃথিবী ঢুকে যাবে’ (সূরা আরাফ : ৯৬)। অন্তর, রূহ, জ্ঞান ও সচেতনতা, আগ্রহ ও ইচ্ছা, আমল ও কর্মতৎপরতার সেই শক্তি ও যোগ্যতার নাম তাকওয়া যার প্রভাবে ক্ষতিকর ও খারাপ কাজকে আমরা ঘৃণা করি আর ভালো কাজের ওপর দৃঢ় হয়ে যাই ও সঠিক মনে করে কর্মতৎপরতা চালাই।
রমজান মানুষকে তার রবের অধিকার বিষয়ে সচেতন করে। এই মহান মাসের আগমনে সবার জীবনে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি। যারা আনুগত্যশীল, এ মাসে তাদের উচিত নেক কাজ বাড়িয়ে দেয়া। তাই আত্মিক ও বস্তুগত সব রোজা ভঙ্গকারী বিষয়গুলো আমাদের জেনে নেয়া দরকার। হালাল রুজি ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। রমজান মানুষকে হারাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। রমজান থেকে মুসলিম উম্মাহ ঐকান্তিকভাবে শিক্ষা নেয়, বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকে, জিহ্বায় লাগাম টানে, হৃদয় পরিচ্ছন্ন রাখে, ব্যবহারকে সুন্দর করে, হিংসা-রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা নেয়। ফলে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো অভিন্ন সুতোয় বেঁধে নেয়ার সুযোগ পায়। রমজান জীবনের মিশনকে আয়ত্ত করার এক বিরাট সুযোগ। তাই আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমেই স্বাগত জানাতে হবে রমজানকে। সব পাপ ও গুনাহ থেকে তওবার মাধ্যমে স্বাগত জানাতে হবে মাহে রমজানকে। যাদের অধিকার হরণ করা হয়েছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই স্বাগত জানাতে হবে রমজানকে। ভালো কাজের মধ্যে দিন যাপনের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে হবে মাহে রমজানকে।
রমজান শাসক ও শাসিতের মাঝে যোগাযোগের একটি উপলক্ষ। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচুদের মধ্যে সম্পর্কসেতুর একটি বড় মাধ্যম। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বারণ করার এক বিরাট সুযোগ। রমজান সামাজিক, চিন্তাগত অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার একটি উপলক্ষ। মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মোক্ষম সময় রমজান। তাই তাদের উচিত রমজান এলে বেশি বেশি আত্মসমালোচনায় মনোযোগী হওয়া।
তাকওয়া অর্জিত হলেই কেবল রোজা আমাদের পাপকে জ্বালিয়ে দেবে। তাই শুধু তেলাওয়াত নয় বরং কুরআনকে অর্থ ব্যাখ্যাসহ পড়ে আমল করা জরুরি। এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, জীবনের পারপাস কী, আমাদের দায়িত্ব কী আর পশুর মতো দেহটি কিভাবে পরিণত হবে মানুষে।
আরো বুঝতে পারব- রোজা আসে রোজা যায় তবুও সমাজ থেকে পাপাচার, অন্যায়, পশুত্ব, রাহাজানি কেন দূর হয় না। তাই এই রমজান হোক নিজেকে বদলে দেয়ার, পাপ কালিমাকে মুছে দেয়ার, আর আল্লাহর রহমত পাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তুলবার। আহলান সাহলান মাহে রমজান।
লেখক: ব্যাংকার