ইসলাম, গণতন্ত্র এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা

0
949
blank
blank
গোলাম মাওলা রনি: জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর একটি অনিন্দ্য সুন্দর ওয়াজ শুনতে গিয়েই শিরোনাম প্রসঙ্গে লিখার তাগিদ অনুভব করলাম। একজন ঘোর আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে বহুবার চেষ্টা করেছি তার ওয়াজ-নসিহত শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। কিন্তু পারিনি। সাঈদীর সুললিত কণ্ঠ, বিষয়বস্তুর গাঁথুনি এবং চমৎকার পরিবেশনার কারণে যেকোনো উপাখ্যান এত জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন কুরআনপাগল মানুষ সেই সুর-লয় ছন্দের মোহময় আকর্ষণ থেকে চেষ্টা করলেও নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। গাড়িতে বসে আমি সবসময় পবিত্র কাবা শরিফের কয়েকজন ইমামের মুখনিঃসৃত তেলাওয়াত শুনি, নতুবা ইউটিউব থেকে সাঈদী সাহেবের ওয়াজ শুনি। যে ওয়াজ কেন্দ্র করে আজকের প্রসঙ্গের অবতারণা, সেটি তিনি করেছিলেন ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার কিছুদিন পর। বাংলাদেশে তখন অস্থিরতা শুরু হয়েছিল এবং ভারতে বেঁধে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যখন মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন পার করছিলেন, ঠিক তখন সাঈদীর এমনতর ওয়াজ আমাকে অবাক না করে পারেনি। কারণ আরো অনেক লোকের মতো আমিও তাকে কট্টর হিন্দুবিরোধীÑ বিশেষ করে ভারতবিরোধী গোঁড়া সাম্প্রদায়িক মুসলিম ভাবতাম। কিন্তু সেদিনের ওয়াজ শোনার পর আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম।

ইসলামে গণতন্ত্র, ভিন্ন মত এবং অপরাপর ধর্ম সম্পর্কে কী বিধান রয়েছে, তা নিয়ে মাওলানা সাঈদী যত সুন্দরভাবে ওয়াজ করেছিলেন, তত সুন্দর করে যে লিখতে পারব না, সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরও লিখতে বসেছি মূলত হৃদয়ের নিদারুণ মর্মবেদনার কারণে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গে সামান্য আলোচনা করা আবশ্যক। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত, বায়তুল মোকাররমে এসব কী হচ্ছে শিরোনামের নিবন্ধটি নিয়ে বাংলাদেশের একজন সম্মানিত পণ্ডিত ব্যক্তি কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রফেসর ইমেরিটাস এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী আমার কাছে আব্বাসীয় শাসক বাদশাহ হারুন আল রশিদের ৩৫ জন স্ত্রীর নাম জানতে চেয়েছেন। তিনি বাদশাহ হারুন সম্পর্কে আমার জানাশোনার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ এবং কতগুলো বই পড়ার অনুরোধ করেছেন। তার সম্মানার্থে অতি সংক্ষেপে তার প্রতিক্রিয়ার জবাব দিয়ে আজকের মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো।
১৯ ফেব্রুয়ারির নিবন্ধে আমি স্পষ্টতই বলেছিলাম বাদশাহ হারুন মুতাজিলা মতের অনুসারী ছিলেন। তিনি শিয়া বা সুন্নী মতবাদের অনুসারী তো ছিলেনই না বরং দুই মতবাদের শীর্ষ আলেমেরা তার নিজের দ্বারা এবং তার পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আরব্য রজনীর মহানায়ক শিরোনামে বাদশাহ হারুন আল রশিদকে নিয়ে প্রায় ২০টি ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখেছিলাম ২০১৪-১৫ সালে। এ কাজ করতে গিয়ে আমাকে ড. ইয়াকুব বর্ণিত বই ছাড়াও আরো অনেক বই পড়তে হয়েছে এবং বহু সময় ব্যয় করে গবেষণা করতে হয়েছে। কোনো কিছু লেখার আগে অবশ্যই ধরে নেই যে, আমার চেয়েও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা লেখাটি পড়বেন এবং ভুল হলে আমাকে রেহাই দেবেন না। বাদশাহ হারুন সম্পর্কে আমার অতিরিক্ত সতর্কতা ছিল তিনটি কারণে। প্রথমত, তিনি আল্লাহর রাসূল সা:-এর বংশধর, দ্বিতীয়ত, তিনি মৃত ব্যক্তি এবং তৃতীয়ত, তিনি অনেক মুসলমানের আবেগ ও ভালোবাসার পাত্র।
ড. ইয়াকুব প্রশ্ন তুলেছেনÑ চারজন স্ত্রীর বেশি বিয়ে করা যেখানে ইসলাম অনুমোদন করে না, সেখানে বাদশাহ হারুন কিভাবে ৩৫টি বিয়ে করলেন? এ ব্যাপারে আমার চেয়ে ওই বাদশাহ এবং তার সমর্থকেরাই ভালো বলতে পারবেন। যারা তার মুতাজিলা মতবাদের বিরোধিতা করতেন এবং তার ৩৫ জন স্ত্রীর ব্যাপারে আপত্তি জানাতেন, তাদের সাথে সহমত পোষণ করে স্ত্রীদের নাম প্রকাশ করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। বাদশাহ হারুনের স্ত্রীদের নাম ছিল যথাক্রমেÑ জুবায়দা বিনতে জাফর, উম্মে মুহাম্মদ, আব্বাস্সাহ, উথমানিদ, গাধির, হাইলানাহ, দানাইর, শিহর, দাইয়া, দাত আল কাহল, ইনান, রিইম, ইরবাহ, সাহধারাহ, লুবথ, রাওয়াহ, দাওয়াজ, কিতমান, হুলাব, ইরাবাহ, হামদুনাহ, ঘুমাস, সুক্কার, রাহিক, সাজার, খজক, হালি, আনিক, সামানদাল, জিনাহ, কাসিফ, আমাত আল আজিজ, মারাজিল বিনতে উস্তাধিস, মারিধাহ বিনতে সাবিব এবং আজিজাহ বিনতে হাদি।
আজকের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, এক ধরনের মনোবেদনা থেকেই শিরোনাম নিয়ে লেখার তাগিদ অনুভূত হয়েছিল। মনোবেদনার মূল কারণ ছিল তিনটি। প্রথম দু’টি হলো নিজেকে নিয়ে এবং তৃতীয় হলো আলেম ওলামাকে নিয়ে। প্রথম কারণ হলো, ইসলাম সম্পর্কে আমি খুবই কম জানি। দ্বিতীয়ত, যতটুকু জানি, তাও দ্বীনের প্রয়োজনে ঠিকমতো ও সময়মতো ব্যবহার করি না। তৃতীয়ত, আমার চেয়েও জ্ঞানী-গুণী আলেম ওলামা কেন দ্বীনের প্রয়োজনে সাইদী সাহেবের মতো নজির সৃষ্টি করছেন না, তা নিয়ে আমার আফসোসের সীমা-পরিসীমা নেই। আমরা সবাই মিলে যে যার অবস্থান থেকে যদি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সাধ্যমতো শ্রম দিতাম, তবে মুসলমানদেরকে দায়ী করে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী বিরূপ মন্তব্য করার সুযোগ পেতেন না। জাতির ক্রান্তিলগ্নে জনাব সাইদী লাখো লোকের সমাবেশে প্রচণ্ড সাহস নিয়ে সজোরে বলেছিলেন, ভারতের হিন্দুরা যদি সে দেশের সব মসজিদ ধ্বংস করে দেয়, তার পরও বাংলাদেশের কোনো মুসলমান এ দেশের কোনো মন্দিরে হামলা চালাতে পারবে না। কারণ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পরধর্মসহিষ্ণু জাতির নাম মুসলমান। পবিত্র কুরআন এবং আল্লাহর রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শ আমাদের গণতান্ত্রিক ও পরধর্মসহিষ্ণু হতে শিখিয়েছে।
এ বক্তব্যের সপক্ষে জনাব সাইদী একটি হাদিসের উল্লেখ করেছেন। হুজুরে পাক সা: বলেন, ‘কোনো মুসলমানসংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলমানদের দ্বারা যদি কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে রোজ কিয়ামতে আমি নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: নির্যাতনকারী মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা দায়ের করব।’ মুসলমান রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, সিপাহি সেনাপতি, কবি-সাহিত্যিক এবং সম্মানিত অলি আল্লাহরা গত ১৪০০ বছরে রাসূল সা:-এর উপরিউক্ত হাদিসটি কিভাবে পালন করেছেন, তার নজির তাবৎ দুনিয়ার পথেপ্রান্তরে, নগরে বন্দরে এবং জনপদগুলোতে উজ্জ্বল তারকার মতো জ্বলজ্বল করছে। অতি সম্প্রতি পশ্চিমা গবেষকেরা বলেছেন যে, ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে শাসকেরা যদি পরধর্মসহিষ্ণু না হতেন তাহলে সেখানে হিন্দুদের খুঁজে পাওয়া যেত না।
ধর্মের বিস্তার সবসময় রাজনীতির ওপর নির্ভর করে। বৌদ্ধধর্ম আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে তারা দু’বার পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, ক্ষমতাবান এবং বৃহত্তম সাম্রাজ্যের সম্রাটের একচেটিয়া রাজানুকূল্য পেয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সম্রাট অশোকের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারতসহ তৎকালীন দুনিয়ায় বৌদ্ধধর্মের অমিয় বাণীগুলো পৌঁছে যায়। অশোক ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাতি এবং সম্রাট বিন্দুসারের পুত্র। একটি নামকরা রাজবংশের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে তার অভিজ্ঞতা, আভিজাত্য এবং অজেয় সামরিক শক্তির প্রভাব তৎকালীন দুনিয়ার সব রাজদরবারে পৌঁছে গিয়েছিল। সম্রাট অশোকের দূত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেখানেই গমন করেছিলেন সেখানেই তাদের জন্য রাজানুকূল্য অবারিত ছিল। এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকে জ্যামিতিক হারে।
বৌদ্ধরা দ্বিতীয়বার রাজানুকূল্য লাভ করেন চীন সম্রাট কুবলাই খানের কাছ থেকে। চেঙ্গিস খান প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যটি সম্রাট কুবলাই খানের আমলে এত বিশাল আকার ধারণ করে যে, বর্তমান জমানায় ওই বিশাল সাম্রাজ্য এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় পরিচালনা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। মানবজাতির ইতিহাসে কুবলাই খান হলেন সেই সম্রাট, যিনি নিজে এবং তার পরবর্তী বংশধরেরা প্রায় ১০০ বছর ধরে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ ভূ-খণ্ডটি শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার দরবারে চাকরি করতেন বিশ্ববিখ্যাত ইতালীয় পর্যটক মার্কো পলো। দ্য ট্রাভেল অব মার্কো পলোতে তিনি লিখেছেন ‘কুবলাই খান অনুভব করলেন যে, তার সাম্রাজ্যের বিশাল জনগোষ্ঠীকে কেবল সামরিক শক্তি, সুশাসন এবং উন্নয়ন দ্বারা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। তিনি মনে করলেন একমাত্র ধর্মের বন্ধনেই এই সুবিশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা, হাজারো বর্ণ ও সম্প্রদায়কে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত আর শান্ত রাখা সম্ভব। তিনি প্রথমে চেয়েছিলেন খ্রিষ্টবাদকে রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য। কিন্তু যথা সময়ে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেয়ে তিনি বৌদ্ধধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন।’
খ্রিষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হজরত ঈসা আ: ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ৩০০ বছর পরেও খ্রিষ্টান ধর্ম কোনো জনপদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু রোম সম্রাট কনসটান্টাইন যেদিন থেকে খ্রিষ্টবাদকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করলেন, এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটি তামাম ইউরোপ এবং পশ্চিমা শক্তির প্রভাবাধীন এশিয়া এবং আফ্রিকার সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। বৌদ্ধধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম কিংবা ইহুদিবাদের মতো রাষ্ট্রীয় মদদে কোনো কালে ইসলাম ধর্মের প্রসার বা প্রচার হয়নি। অথচ গত চৌদ্দশত বছর ধরে মুসলমান শাসকেরা বিশাল পৃথিবীর যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছেন, তা অন্য কোনো ধর্ম মতাবলম্বী শাসকদের ভাগ্যে জোটেনি। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া এবং আব্বাসীয়রা মিলে মোট ৫০০ বছর সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পারস্য ও স্পেন শাসন করেছিলেন। অন্য দিকে, ভারতবর্ষের সুলতানী আমল থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত মুসলমানদের শাসনকাল প্রায় ৮০০ বছর। অন্য দিকে, তুরস্কের অটোম্যানরাও ৮০০ বছর ধরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, বৃহত্তর যুগোশ্লাভিয়া, ইটালি ও অস্ট্রিয়ার কিছু অংশ, রাশিয়ার বিরাট অংশসহ পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূ-খণ্ড শাসন করেছিলেন। তবুও মুসলমানদের রাজ্যে মুসলমানেরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মতো সংখ্যালঘু ছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য শুনলে কখনো-কখনো অবাক না হয়ে পারা যায় না। মুসলমানদের সুবর্ণসময় বাদশাহ হারুন আল রশিদের রাজত্বকালে। তার সাম্রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল শতকরা হিসেবে মাত্র ৮ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন হলোÑ মুসলমান শাসকেরা চীন দেশের সম্রাট কুবলাই খান কিংবা রোমান সম্রাট কনসটান্টাইনের মতো কট্টর অবস্থানে গিয়ে কেনো ইসলামকে তাদের জনগণের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেননি? এর মূল কারণ, ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা। ইসলাম চাপিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। পৃথিবীর কোথাও তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মানুষের হৃদয় জয় করেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম একমাত্র ধর্ম, যেখানে অন্যান্য ধর্মকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ধর্মের অনুসারী এবং তাদের নবী ও রাসূল সম্পর্কে ইসলাম শ্রদ্ধা পোষণ করার নির্দেশ দেয়। এমনকি পৌত্তলিকদের দেবতা কিংবা অগ্নি উপাসকদের উপাস্য সম্পর্কে কটূক্তি না করার জন্য কুরআন এবং হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শাসক হিসেবে মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং বিচারক, সেনাপতি কিংবা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে একজন মুসলমানের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনার মধ্যে কিছু রয়েছে সরাসরি হুকুম, কিছু রয়েছে শরিয়তের বিধান এবং কিছু রয়েছে বিস্তারিত উপাখ্যান, যার মাধ্যমে মুসলমানেরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করে থাকেন।
ইসলাম তার অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছে দেশে-বিদেশে, কর্মক্ষেত্রে এবং গৃহের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার জন্য। কোনো বিষয় গোপন রাখা, ছলচাতুরী করা, মোনাফেকি এবং কাউকে ঠকানোর রীতি ইসলাম সমর্থন করে না। স্বচ্ছতা এবং জববাদিহিতা শব্দ দু’টি প্রত্যেকটি মুসলমানকে ঘরে বাইরে সর্বত্র অনুসরণ করার জন্য বলা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা: তাঁর স্ত্রীদের অছিয়ত করেছিলেন তাঁর গৃহের অভ্যন্তরের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জিজ্ঞাসিত হলে প্রকাশ করে দেয়ার জন্য। ব্যক্তি জীবনে এর চেয়ে স্বচ্ছতা প্রকাশের দুঃসাহসী কর্ম আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না, যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: দেখিয়েছিলেন। অন্য দিকে, জবাবদিহিতার শত-সহস্র অতি উত্তম নজিরের মধ্যে হজরত ওমর রা:-এর একটি ঘটনা আজো ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। মসজিদে খুৎবার সময় জনৈক সাহাবার প্রশ্নÑ কেন আপনার জামাটি এত লম্বা হলো? হজরত ওমরের উত্তর কী, বর্তমান গণতান্ত্রিক আমলে কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেন কি? আধুনিক সভ্যতার পাদপীঠে দাঁড়িয়ে যা কল্পনা করা সম্ভব নয়, সেই কঠিন সত্যগুলো কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে আবের মরুর বুকে শুধু ইসলামের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে।
ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, এই ধর্মের অনুসারীদের পরধর্মসহিষ্ণুতা। ইসলাম বর্ণবৈষম্যে বিশ্বাস করে না। ইসলাম জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ মানে না। ধর্ম, বংশ, গায়ের বর্ণ, অর্থনৈতিক অবস্থা, পদ-পদবি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থাভেদে ইসলাম মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে না। ইসলামের মতে, সব মানুষ সমান। সবারই অধিকার সমান। ইসলাম মানুষের দেবত্বে বিশ্বাস করে না। মানুষের মধ্যে সুপারম্যান সৃষ্টি করে না এবং কোনো অজুহাতে অন্যায়কারীর পক্ষ নেয়ার সুযোগ রাখে না। ইসলামে ন্যায়বিচার, সুশাসন আর বিবেকের সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে ন্যায়পরায়ণ শাসকের সম্মান যেমন সর্বোচ্চ স্থানে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি জালিম শাসক এবং অসৎ বিচারকের স্থান দেয়া হয়েছে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে।
ইসলামের কঠোর নীতিবোধ এবং শিক্ষার কারণেই গত চৌদ্দশত বছর ধরে মুসলমানেরা আজো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পরধর্মসহিষ্ণু জাতি। এ কারণেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সবসময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে অধিক নিরাপত্তা, সহমর্মিতা এবং সুখশান্তি লাভ করে আসছে। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা ভারত, চীন কিংবা ব্রিটেনের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ এবং সুখশান্তিতে আছে। এমন কি, তালেবান আমলে আফগানিস্তানে একজন হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ লাঞ্ছিত হয়েছে। এমন অভিযোগ আজ পর্যন্ত করতে পারেনি কেউ। মিসরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, ইরানের অগ্নি উপাসকেরা, লেবাননের ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সে দেশের জনগণ বা রাষ্ট্রশক্তি দিয়ে নির্যাতিত হয়েছে এমন খবর নেই। অথচ মুসলমানেরা নির্যাতিত হয়নি এমন কোনো পশ্চিমা দেশ কিংবা গণতান্ত্রিক বলে বুক ফুলিয়ে চলা দেশের নাম কেউ কি বলতে পারবেন?
মুসলমানদের পরধর্মসহিষ্ণুতা এবং অন্য ধর্ম সম্পর্কে সম্মানবোধের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করে আজকের লেখা শেষ করব। মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস রা: মিসর জয় করেন ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে। মিসর জয়ের কয়েক দিন পর খ্রিষ্টান পাদ্রীদের একটি দল এসে হজরত আমর ইবনুল আস রা:-এর কাছে অভিযোগ করলেন, মুসলমানদের মিসর জয়ের পর কে বা কারা তাদের নবী হজরত ঈসা আ:-এর একটি মূর্তির নাক ভেঙে দিয়েছে। আমর ইবনুল আস রা: পাদ্রীদের ন্যায়বিচারের আশ্বাস এবং রাষ্ট্রের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীকে দ্রুত অপরাধীকে গ্রেফতার করে তার সামনে আনয়ন করার নির্দেশ দিলেন। কয়েক দিনের প্রাণান্ত চেষ্টার পরও অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হলো না। এ অবস্থায় তিনি খ্রিষ্টান পাদ্রীদের দরবারে ডেকে আনলেন এবং বললেন- ‘আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেও অপরাধীকে পাকড়াও করতে পারিনি। অপরাধী আপনাদের নবীর মূর্তির নাক ভেঙে মূলত আপনাদের অপমান করার চেষ্টা করেছে। হজরত ঈসা আ: আমাদেরও নবী। এ কথা বলে তিনি তার তলোয়ার পাদ্রীদের হাতে দিয়ে বললেন- অপরাধী একটি মূর্তির নাক ভেঙে আপনাদের অপমান করেছে, তেমনি আপনারা তলোয়ার দিয়ে আমার নাকটি কেটে ফেলুন। এতে হয়তো অপরাধী তার কাজের সমুচিত জবাব পেয়ে যাবে।