ইসির স্বাধীন ভূমিকা চায় বিএনপি

0
476
blank

মঈন উদ্দিন খান: নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) স্বাধীন ভূমিকায় দেখতে চায় বিএনপি। দলটি মনে করছে, দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন যদি কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি না করে পুরোপুরি সংবিধান ও আইনের অধীন থাকে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। ইসির সাথে আসন্ন সংলাপে বিএনপি এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি বিএনপির প্রস্তাবনার মূল বিষয় হিসেবে থাকছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, নির্বাচনের আগে ও পরে অন্তত সাত দিন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ভোটার অনুপাতে সংসদীয় সীমানা পুনর্বিন্যাস কিংবা এ ক্ষেত্রে নবম সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিদ্যমান পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া, নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি স্তরে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন নিশ্চিত করা এবং ভোট গণনার পদ্ধতিকে আরো আধুনিক করার বিষয়গুলো। ইতোমধ্যে ইসির সাথে সংলাপে উপস্থাপনের জন্য বিস্তারিত দলীয় প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছে দলটি।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে আমরা অংশ নেবো। দলের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আরপিওর বিভিন্ন ধারা সংশোধন, আসন পুনর্বিন্যাস, ইভিএম বাতিল, সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব দেয়া হবে। তবে বিএনপির এই নেতা বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মৌলিক বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। যে রোডম্যাপই ঘোষণা করা হোক না কেন কিংবা যে আলোচনাই করা হোক না কেন সহায়ক সরকার ছাড়া সবই হবে অর্থহীন। সহায়ক সরকারের ফয়সালা হতে হবে সবার আগে।

দলটির নেতারা আরো মনে করছেন, ইসির সাথে সংলাপে সহায়ক সরকারের বিষয়টি উঠে আসবে ঠিকই, কিন্তু এর সুরাহা হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এ দাবি আদায়ে সরকারের সাথে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার বিষয়টিও আছে দলটির বিবেচনায়। প্রসঙ্গত, আজ সোমবার থেকে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপ শুরু হচ্ছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি টিম নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে পেশ করার জন্য দলীয় প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন। এ টিমে আছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন কয়েকজন সাবেক আমলা ও বুদ্ধিজীবী। প্রস্তাবনা তৈরির ক্ষেত্রে দলটি তৃণমূলের নেতাদেরও মতামত নিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী এলাকার সীমানা জটিলতার সমাধান কোন পথে হতে পারে, সে বিষয়ে চিঠি দিয়ে জেলাপর্যায়ের নেতাদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বিএনপির প্রস্তাবনার শিরোনাম হচ্ছে- ‘নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে করণীয়’। প্রস্তাবনার ভূমিকা এবং উপসংহারে সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা প্রয়োগের কথা উল্লেখ থাকবে। এরপর নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালীকরণ এবং আরপিওসহ অন্যান্য নির্বাচনী বিধিবিধান সময়োপযোগী ও যৌক্তিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হবে।

নির্বাচন কমিশন কেমন হতে হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে দলটির অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। দলটির নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের সেøাগান সংবলিত ‘ভিশন-২০৩০’ তে নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনগর্ঠনের আগেও দলটি এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রস্তাব তুলে ধরেছিল।

জানা গেছে, এ দু’টি পৃথক প্রস্তাবকে আরো সংক্ষিপ্ত করে ১০-১২টি মৌলিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে দলীয় প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় রয়েছেÑ নতুনভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে নিজস্ব সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সবপর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তা অর্থাৎ রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, আপিল কর্তৃপক্ষ, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা, রেজিস্ট্রেশন অফিসার, সহকারী রেজিস্ট্রেশন অফিসার, রিভাইজিং অথরিটি, নির্বাচন কাজে নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য পোষণকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে প্রত্যাহার এবং প্রত্যাহারকৃত কর্মকর্তাদের যেকোনো ধরনের নির্বাচনী দায়িত্বপালন থেকে বিরত রাখতে হবে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং তাদের মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিগত ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্নপর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং অন্যান্য নির্বাচনী বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে এবং তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রেষণে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকাশ্য রাজনৈতিক মতানুসারী নির্বাচনী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে। একটি কমিটি গঠন করে বিগত ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্নপর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রকাশ্যে দলীয় আনুগত্য পোষণকারীদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। ওই সব চিহ্নিত কর্মকর্তাকে ভবিষ্যতে অন্য যেকোনো নির্বাচনী দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার সময় মাঠপর্যায়ে কর্মরত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নতুন কর্মকর্তা পদায়নে বিগত পাঁচ বছর বিভিন্ন পদমর্যাদায় ওই জেলায় চাকরিরত ছিলেন এমন কর্মকর্তাদের একই জেলায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পদে পদায়ন করা যাবে না, একইভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় প্রত্যেক উপজেলা এবং থানায় কর্মরত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতঃপূর্বে কোন সময় যেকোনো পদমর্যাদায় ওই উপজেলা বা থানায় চাকরিরত ছিলেন এমন কোনো কর্মকর্তাকে একই উপজেলায় বা থানায় নিয়োগ প্রদান করা যাবে না, নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার প্রাক্কালে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমনÑ স্বরাষ্ট্র, অর্থ, তথ্য, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পররাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকতে হবে। সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।

প্রস্তাবে আরো রয়েছে- ভোটগ্রহণের আগে বিভিন্ন বুথে খালি বাক্স সরবরাহের পর অবশিষ্ট শূন্য ব্যালট বাক্সগুলো (যদি থাকে) এমন নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে, যাতে তা প্রার্থী অথবা নির্বাচনী এজেন্ট অথবা পোলিং এজেন্টদের কাছে দৃশ্যমান থাকে। ভোট চলাকালে ব্যালট বাক্স পরিপূর্ণ হয়ে গেলে ব্যালটভর্তি বাক্স বা বাক্সগুলো সংশ্লিষ্ট বুথেই রাখতে হবে যাতে তা সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং নির্বাচনী এজেন্ট অথবা পোলিং এজেন্টদের কাছে দৃশ্যমান থাকে। ভোট শেষে ব্যালট গণনার জন্য কেবল ভোটগ্রহণে ব্যহ্যত ব্যালট বাক্সগুলো খোলা হবে। প্রিজাইডিং অফিসার তার স্বাক্ষরিত ফলাফল শিট ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে হস্তান্তর না করে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করবেন না। নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক এজেন্টদের তালিকা ও তাদের নমুনা স্বাক্ষর নির্বাচনের দিনের আগেই প্রার্থীর কাছ থেকে সংগ্রহ করবে এবং তা গোপন রাখতে হবে। প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় ওই কেন্দ্রের প্রত্যেক বুথে প্রার্থীর নিযুক্ত পোলিং এজেন্টকে অবশ্যই উপস্থিত রাখতে হবে, ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভোট গণনা শুরু করতে হবে।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়া এবং ভোট গণনা শুরুর মধ্যবর্তী সময়ে কোনো বিরতি দেয়া যাবে না।
প্রস্তাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি। বিএনপি মনে করছে, ১৯৮৪ সাল থেকে বজায় থাকা সংসদীয় সীমানা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন কমিশন কারো কোনো দাবি না থাকা সত্ত্বেও একক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওই সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে শতাধিক আসনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি এখন ভোটার অনুপাতে সীমানা পুনর্বিন্যাস কিংবা ২০০৮ সালের আগের ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয়টিতে জোর দেবে।

মূল বিষয় হিসেবে আরো থাকছে- নির্বাচনকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতা প্রদান করে সব নির্বাচনী এলাকায় টহলসহ ভোটকেন্দ্র ও বিশেষ বিশেষ স্থানে মোতায়েনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতা প্রদান করতে হবে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার অব্যবহিত পর থেকে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি ও অন্যান্য নির্বাচনী বিধিবিধান ভঙের অভিযোগপত্র এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে দাখিলকৃত অভিযোগপত্র গ্রহণ এবং লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে, তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর প্রতিবিধান করতে হবে এবং গৃহীত কার্যক্রম জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।

এ ছাড়া গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা, অসমর্থিত সূত্রের ভিত্তিতে ভোটের ফল প্রকাশ না করা এবং পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়াসহ নানা বিষয় থাকছে বিএনপির প্রস্তাবনায়।