ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: গত বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টায় আসাদ গেটের সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে আমার এক বন্ধু ফোন করেন বললেন, ব্যাংকে তো এসেছিলাম কিন্তু কোনো লোকজন নেই। কর্মচারীরা কেউ নেই শুধু দু-একজন গ্রাহক এসে ফিরে যাচ্ছেন। তাকে বললাম পাশে জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর অফিসে ঢুকেন, দেখেন সেখানে কী অবস্থা? তিনি জানালেন একই অবস্থা। কোথায়ও কেউ নেই। দু’জায়গায় দু’জন ম্যানেজার বসে আছেন একা। শেষ পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কারণ কী? ম্যানেজার জবাব দিলেন, আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে অতিক্রম করেছে বলে সারা দেশে আনন্দ র্যালি হচ্ছে। সে র্যালিতে যোগ দেয়ার জন্য আমাদের অফিসের কর্মচারীরা সকাল সকালই চলে গেছেন। দুটি প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। সে জন্য এক আয়োজন, আবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তার পর চলবে আতশবাজি। ফলে এক ধুন্ধুমার অবস্থা। সে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য দেশের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। যে অনুষ্ঠান ৩টায় হবে, তার জন্য সকাল ১০টায় অফিস আদালত খালি হয়ে যাবে কেন? ভালো হতো সরকার যদি বৃহস্পতিবার সারা দেশে ছুটি ঘোষণা করতেন। সেটি সম্ভবত সরকার করতে চায়নি। কারণ তারা নিশ্চিত জানে, বৃহস্পতিবার ছুটি পেলে শুক্র, শনিবার বন্ধ। সব লোক ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে। তাদের সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। স্কুলের ছোট ছোট শিশুদের কেন রাস্তায় দাঁড় করে রাখা হলো তাও বোঝা মুশকিল।
এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ৯টি পয়েন্টে যান চলাচল কার্যত বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ফলে সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়। যারা সরকারি চাকরি করে না, তাদের হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অনেক জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করে। অনেক জায়গায় যানবাহন শূন্য হয়ে পড়ে, সে ভোগান্তি ছিল সীমাহীন। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এখন থেকে ছয় বছর পরে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে কেন আদেখলেপনা এই সংবর্ধনা আর উৎসবের আয়োজন? প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছিল বলে সরকারি দাবি। কিন্তু সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘চূড়ান্ত যোগ্যতা অর্জন করতে এখনো ছয় বছর বাকি, প্রাথমিকভাবে মনোনীত হওয়ায় এত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের কারণ কী?’ এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা বরাবরই উৎসবপ্রিয় জাতি। ছোটখাটো কিছু হলেই আতশবাজি করা হয়। আমরা প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলেও এটি আমাদের জন্য বিরাট অর্জন। আমাদের এখন কাজ বেড়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে, আমাদের অনেক দূর যেতে হবে, এসব অনুষ্ঠান থেকে আমরা তার প্রেরণা পাবো।
কার্যত জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী বিশ্ব প্রকৃতিপক্ষে দু’ভাগে বিভক্ত- একটা উন্নত, আরেকটা স্বল্পোন্নত (এলডিসি)। এ স্বল্পোন্নত কথাটা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অসম্মানজনক বিবেচনা করে জাতিসঙ্ঘ ১৯৬৪ সালে স্বল্পোন্নতের বদলে দরিদ্র দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে স্বল্পোন্নত আর উন্নয়নশীলের মধ্যে মার্থক্য খুবই কমে আসে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৯৯৫ ডলারেরও কম, তারা অতিদরিদ্র। যাদের ৯৯৬ থেকে তিন হাজার ৯৪৫ ডলার পর্যন্ত বার্ষিক মাথাপিছু আয় তাদের নি¤œমধ্যবিত্ত দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আবার যাদের আয় তিন হাজার ৯৯৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ১৯৫ ডলার পর্যন্ত তাদের উচ্চমধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর ১১ হাজার ৯০৬ ডলারের উপরে যাদের মাথাপিছু আয় তাদের উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গুগলের হিসাবে এখন আর এলডিসি বলে কোনো দেশ নেই। আছে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ।
তবে যখন কোনো দেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্য বা উচ্চ মধ্যম দেশে পরিণত হয় তখন তাকে সুনজরেই দেখা হয়। এ সময় তার ওপর বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাসংস্থা ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া হয়। সাহায্য-সহযোগিতাও কমিয়ে দেয়া হয়। এখানে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে : আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউওয়ান একটি বই লিখেছেন তার নাম ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট। সেই বইতে তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে, কিভাবে তিনি দীর্ঘ দিন ইউনিসেফের সহায়তা নিয়ে তার দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ করে ফেলেছিলেন। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী অনেক আগেই সিঙ্গাপুর ৪০-৪৫ শতাংশ সাক্ষরতার হার অতিক্রম করেছিল। কিন্তু লি কুয়ান ইউওয়ান প্লেনের ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণ করে ইউনিসেফের সদর দফতরে বারবার হাজির হতেন।
বলতেন যদি তোমরা আমাকে আর্থিক সাহায্য না দাও বা বন্ধ করে দাও তাহলে আমার দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষাবঞ্চিত থেকে যাবে। এভাবেই তিনি তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছিলেন। ফুটানি করে একেবারে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি। যা হোক, এর আগে ১৯৯৪ সালে বোৎসোয়ানাকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৭ সালে ভারতে, ২০১১ সালে মালদ্বীপ, ২০১৪ সালে সামোয়া এই চারটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে ঘানা, পাপুয়া নিউগিনি ও জিম্বাবুয়েকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে চেয়েছিল জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু এই তিন দেশ সে ঘোষণা মেনে নেয়নি। কারণ তারা বলছে জাতিসঙ্ঘের হিসাবের গরমিল আছে।
অর্থাৎ তারাও সিঙ্গাপুরের মতো যত দিন সম্ভব জাতিসঙ্ঘের সুবিধাদি গ্রহণ করতে চান এবং বিশ্বের ঋণদাতা সংস্থাগুলো ঋণ কম সুদে নিতে চান। তবে উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশগুলোর মাথাপিছু আয় দিয়ে তাদের মর্যাদা বিবেচনা করা হয় না। অর্থনৈতিক অবস্থা, জিডিপি, জিএনপি, মাথাপিছু আয়, শিল্পায়ন, জীবনযাত্রার মান, সুশাসন, কারিগরি অবকাঠামো প্রভৃতি বিষয়ক বিবেচনায় নেয়া হয়। উন্নত দেশ বলতে বোঝায় উচ্চমানের শিল্প উন্নয়ন যার ভিত্তি হবে কারিগরি বিদ্যা ও শিল্পোৎপাদন, কৃষি নয়। সেখানে মানবিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়। উৎপাদন এবং ভোগ হয় উচ্চ পর্যায়ের, মাথাপিছু আয় হয় অনেক বেশি। ফলে উন্নত দেশগুলোর মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়।
সাধারণত উন্নত দেশ হওয়ার প্রথম শর্ত শিল্পায়ন এবং তাদেরকে ধরা হয় প্রথম বিশ্ব। যেমন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, জাপান, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ধরা হয়। অপর দিকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সেগুলোই যেখানে শিল্পায়ন কম, জন্মহার বেশি, মৃত্যু হারও বেশি, শিশুমৃত্যুর হার বেশি, পুষ্টির অভাব, চিকিৎসাসেবা কম, স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা। সুতরাং উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের থাকে নি¤œ বা মধ্যম মানের জীবনযাত্রা। কারণ, তাদের মাথাপিছু আয় কম থাকে। তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শীর্ষে পৌঁছেনি। সম্পদের বণ্টন অসম। উৎপাদন ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহৃত নয়। ফলে উন্নয়নশীল দেশ বলতে বোঝায় তৃতীয় বিশ্ব বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো।
তাহলে আমরা কোন ধোঁকায় পড়লাম। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য মান অনুযায়ী উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কৌশলে প্রশ্ন অবশ্যই আছে। আসলে সেটাই ছিল বড় কথা। তাছাড়া আমরা যদি মেনেও নিই যে, স্বল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে তাহলে সে পার্থক্য দূর করতে আমাদের এখনো ছয় বছর সময় লাগবে। তার জন্য যে হারে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে সে মাত্রা ছাড়িয়ে ২ ডিজিটে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে, শিল্প বলতে প্রথমত গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি তাও শত শত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখানেও বেকারত্ব বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ায় রেমিট্যান্স কমছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় মানুষের পুষ্টি মাত্রা দ্রুতই হ্রাস পাচ্ছে। আর সরকারি লোকেরা নানা কৌশলে ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিচ্ছে। এখন ব্যাংকে কঠিন অর্থ সঙ্কট। তারা গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের উপযুক্ত অর্থঋণ দিতে পারছে না। যারা দিতে পারছে তারাও ৮ শতাংশ সুদ থেকে বর্তমানে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ আদায় করছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। রফতানি কমছে, আমদানি বাড়ছে। ছয় বছরে জনসংখ্যাও আরো বাড়বে এবং বর্তমান ব্যাংক লুটের ধারা অব্যাহত থাকলে শিল্পায়ন পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। তাতে জীবনযাত্রার মান আরো পড়ে যাবে।
সুতরাং এত গর্ব করার কী আছে! শেষ করার আগে একবার উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত এই তিন ধরনের দেশের ওপর আলোকপাত করতে চাই। উন্নত দেশগুলোর অবকাঠামো হলো যথাযথ যেমন : সড়ক, সেতু, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনের পানি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা এসবই থাকে। এসব দেশ তাদের সব নাগরিকের জন্য এই অবকাঠামোগত সেবা এবং যথাসময়ে মেরামতি কাজ সম্পন্ন করতে পারে। ডাক্তার ও চিকিৎসার কোনো অভাব হয় না। সংক্ষেপে একটি উন্নত দেশের তিনটি জিনিস থাকে। এর থাকে স্টাফ, তাদের দেখভালের লোক থাকে, তারা যথাযথভাবে ট্যাক্স দেয়, তাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং ক্রম ঊর্ধ্বগামী। উন্নত দেশের একটি বড় উদাহরণ জার্মানি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থাও প্রায় একই। তবে তাদের অবকাঠামো পুরনো এবং ব্যবস্থাপনা খুব খারাপ। জনগণের খরচ করার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই, নেই দক্ষ জনশক্তি। উৎপাদিত পণ্যের মান খারাপ, সেবার মান উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক নিম্ন। এসব দেশের দুর্নীতি একটা রোগ। তবে অর্থনীতিক উন্নয়ন দৃশ্যমান যেমন : ভারত। অনুন্নত দেশের বিপুলসংখ্যক লোক আছে, তবে তাদের কাজে লাগানোর মতো যথাযথ অবকাঠামো নেই। আয়ও কম, সেজন্য সরকারকে তারা কর দিতে চায় না। এটা প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। তাছাড়া এসব দেশের সরকার সাধারণত দুর্নীতিবাজ হয়। ফলে এই সরকারগুলোকে সরকার বলা হাস্যকর হয়ে ওঠে। এর ভালো উদাহরণ শাদ।
এখন নিজেরাই বেছে নিতে পারি আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্রের ভেতরে পড়ি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.