একের পর এক দুর্ঘটনা: বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

0
488
blank

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক হলো সব ব্যাংকের ব্যাংক। এ ব্যাংকে তফসিলি ব্যাংকগুলোর অর্থ জমা রাখে। আবার সঙ্কটে পড়লে তা উত্তোলন করে। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র কেপিআই হিসেবে পরিচিত এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়। এর পরের সপ্তাহেই অর্থাৎ ৭ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতি হয়। এতে ৪০ জন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে নিরাপত্তাবলয় ভল্টের কাছ থেকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দীপক চন্দ্র দাশ নামক এক কর্মকর্তা পাঁচ লাখ টাকা চুরি করে। যদিও তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ না করে ছেড়ে দেয়া হয়। এর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মেইল হ্যাকড হয়। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগে আগুন লাগে। এসব ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা সুরক্ষিত না হলে আর কোথায় সুরক্ষা আছে তা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনায় একের পর এক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আগুনে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তবে আগের ঘটনার সাথে আগুনের ঘটনার বিভিন্ন বিষয়ে মিল রয়েছে। এ কারণেই এটা নাশকতা হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছিল তিন দিন ছুটি সামনে রেখে। ২৬টি ব্যাংকের এটিএম কার্ড কোন হয়েছিলও তিন দিনের ছুটি সামনে রেখে। আবার আগুনের ঘটনাও ঘটেছে তিন দিনের ছুটি সামনে রেখে। সুতরাং বিষয়টিকে স্রেফ আগুন বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিষয়টিকে অনুধাবন করেই উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল সরেজমিন দেখে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
এ দিকে কেপিআই হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যালার্মিং সিস্টেম রয়েছে। প্রতিদিনই ট্রায়াল হিসেবে ব্যাংক ছুটির আগে অ্যালাম বাজানো হয়। কিন্তু গত ২৩ মার্চ রাতের আগুনে কোনো অ্যালাম বাজেনি। আগুন লাগার ঘটনাও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়নি। ফায়ার সার্ভিস জেনেছে বাইরের প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে। এর পরেই তাদের ১২টি ইউনিটের ৭০ জন সদস্য এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যালার্মিং সিস্টেম নষ্ট কি না। আর সেটি নষ্ট হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা বিভাগ নামক একটি বিভাগ কী দায়িত্ব পালন করে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যালার্ম সার্ভিস সিস্টেম ভালো না। মাঝে মধ্যে ফলস অ্যালার্ম দেয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব কর্মী বাহিনীর মহড়া দেয়ার কথা। কিন্তু সেটা নিয়মিত হয় না বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন : একের পর এক দুর্ঘটায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে নিরাপত্তাবলয় ভল্টের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা চুরি করে নিরাপদে বেরিয়েও যান স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার নাম দীপক চন্দ্র দাশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসি টিভিতে ধারণকৃত তথ্য থেকে জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটাতে তিনি সময় নেন মাত্র ৪৬ সেকেন্ড। ওই দিন বিকেল ৫টা ৭ মিনিট ১৮ সেকেন্ড থেকে ৫টা ৮ মিনিট ৪ সেকেন্ডের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার টাকা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের ভল্টে আসা দীপক ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পাঁচ লাখ টাকার একটি বান্ডিল হাতিয়ে নেন। তিনি চুপিসারে তা বাইরে রেখে আবার ভেতরে ঢোকেন। টাকা চুরির বিষয়টি প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেও ভিডিও ফুটেজ দেখানোর পর স্বীকার করেন এবং পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দেন। তার ব্যাংক থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবেÑ এমন লিখিত দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে ছেড়ে দেয়। তবে এমন ঘটনা ধরার পরও পুলিশে সোপর্দ না করে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে ােভ দেখা দেয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার মধ্যস্থতায় দীপক চন্দ্র দাশকে ছেড়ে দেয়া হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়। চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মেইল হ্যাক হয়। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন লাগে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ৩৪টি বিভাগ রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ। এ বিভাগেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এ কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে।
থানায় জিডি : বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডি নম্বর ১৫৭৩। গতকাল সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক নুরুল ইসলাম মতিঝিল থানায় জিডি করেন। এ দিকে গত বৃহস্পতিবার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়।
জিডির বরাত দিয়ে মতিঝিল থানার এসআই ইব্রাহিম জানান, জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত (২৩/৩/২০১৭) রাত আনুমানিক ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের ১৪ তলার বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের পূর্ব-দণি কোণে আগুনের শিখা দেখা যায়। তাৎণিক ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে ৩০ মিনিটের মধ্যে আগুনের শিখা নিভিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে তারা। এ বিষয়ে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক মো: নুরুল ইসলাম।
কোনো গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়েনি : বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুনে পুড়ে যাওয়া জিনিসিপত্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাগজপত্র ছিল না। তবে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও তার ব্যক্তিগত সহকারীর চেম্বার পুরোপুরি পুড়ে গেছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি আগুনে পুড়ে যাওয়া কক্ষ সরেজমিন পরিদর্শন করে এটা দাবি করেছেন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির এক সদস্য। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, মহাব্যবস্থাপকদের রুমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নথি থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নথি থাকে ডেস্ক অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও তার ব্যক্তিগত সহকারীর চেম্বার ছাড়া অন্য কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তিনি বলেন, গতকাল আনুমানিক রাত ৯টা ২০ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। তা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই অর্থাৎ ১০টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আগামী ২৮ মার্চের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে।