ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুরে জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে

0
844
blank
blank

চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সিলেট থেকে: ঘরের আগুন যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সিলেটে তা ভালোই টের পেল আওয়ামী লীগ। দলে বিদ্রোহের কারণে সোমবার সিলেট বিভাগের দুই উপজেলা নির্বাচনে বলতে গেলে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। ৬টি পদের ৫টিই গেছে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা প্রতিপক্ষ বিএনপির ঝুলিতে। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের দুটো পদই দখল করেছেন বিএনপি প্রার্থীরা। একটি ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়েই কেবল সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। অবশ্য ঘরের মাঝে আগুন না লাগলে ফল হয়তো উল্টোই হতে পারতো। দুই উপজেলাতেই ভোটের লড়াই শেষে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের মূল ও বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এক হলে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর ভোটকে খুব সহজেই ছাড়িয়ে যেত।
নির্বাচনে বিএনপির একক প্রার্থী থাকলেও সিলেটের ওসমানীনগর ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর দুই উপজেলাতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নিজ দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের এ কোন্দলের ফায়দা নিয়ে জয়ের মালা গলায় পরেছেন বিএনপি প্রার্থীরা। ওসমানীনগরে নৌকা ও ঘোড়াকে ডিঙিয়ে ধানের শীষ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী ময়নুল হক চৌধুরী। আর জগন্নাথপুরে নৌকা ও আনারসকে পেছনে ফেলে ধানের শীষ নিয়ে বিজয় ঘরে তুলেছেন বিএনপি প্রার্থী আতাউর রহমান। দলে একক প্রার্থী হওয়ার সুবিধা পেয়েছেন তারা।
দুই উপজেলার মধ্যে ওসমানীনগরে মূল লড়াইয়েই আসতে পারেননি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতাউর রহমান। বিজয়ী প্রার্থী বিএনপির ময়নুল হক চৌধুরীর ভোটের অর্ধেকও তিনি নিজের বাক্সে জমা করতে পারেননি। তবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আখতারুজ্জামান চৌধুরী জগলু ছেড়ে কথা কননি বিজয়ী প্রার্থীকে। ঘোড়া প্রতীক নিয়ে ময়নুল হকের একদম ঘাড়ের ওপরই নিঃশ্বাস ফেলেছেন জগলু চৌধুরী। ২ হাজার ১শ’ ভোটের ব্যবধানে হার মানেন তিনি। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ময়নুল হক চৌধুরী দলীয় প্রতীক ধানের শীষে ভোট পেয়েছেন ২০ হাজার ৭৭৮টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জগলু চৌধুরী ঘোড়া প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৯ হাজার ৬৭৮ ভোট, আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী আতাউর রহমান তার নৌকার বাক্সে জমা করতে পেরেছেন ৯ হাজার ৮০৯ ভোট, জাতীয় পার্টির প্রার্থী শিব্বির আহমদ লাঙ্গল নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৪২৪ ভোট। নির্বাচনে নিজেদের একক প্রার্থী থাকলে ফল যে উল্টে যেতে পারত সেটা দিনশেষে ভালোই বুঝেছেন আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা। আবার কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইই ঠিক হয়নি। একসময়ের জনতা পার্টির নেতা আতাউর রহমানকে এখনো অনেকেই মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা ভোট ঢেলেছেন বিদ্রোহীর বাক্সে। আর সেটাই সুযোগ হয়ে ধরা দিয়েছে বিএনপি প্রার্থীর সামনে। দলীয় বিদ্রোহের কারণে ওসমানীনগর উপজেলা থেকে একেবারে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী গয়াস মিয়া। অবশ্য ঠেলাঠেলির কারণে এ পদে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীই ছিল না। গয়াস মিয়া ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২৯ হাজার ৭০৮ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস খান তালা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২১ হাজার ১৪৭ ভোট। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলেও তাকেও বিপুল ভোটে হার মানতে হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর কাছে। বিএনপি প্রার্থী মুসলিমা আক্তার চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ২৫ হাজার ৫৩৪টি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুক্তা পারভীন নৌকা প্রতীকে ১৬ হাজার ৬০ ভোট পেয়েছেন।
জগন্নাথপুরেও বিদ্রোহের কারণে হারতে হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে। অবশ্য এ উপজেলায় মূল লড়াইয়েই ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দ আকমল হোসেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মুক্তাদীর আহমদ মুক্তাকে তৃতীয় অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। দুজনের এ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে চেয়ারম্যানের পদটি দখল করেছেন বিএনপি প্রার্থী আতাউর রহমান। যিনি গেলবার হার মেনেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আকমল হোসেনের কাছে। এবার জয়ী হয়ে প্রতিশোধ নিলেন আতাউর রহমান। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আতাউর রহমান ধানের শীষে ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯১৪টি, আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী আকমল হোসেন নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২৫ হাজার ১৯৮ ভোট, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা আনারস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৩ হাজার ৬১৫ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের মুখ রেখেছেন বিজন কুমার দেব। নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি ভোট পেয়েছেন ২০ হাজার ২৪২ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী সোহেল আহমদ খান টুনু ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ১৫ হাজার ৩৩৮টি। নারী চেয়ারম্যান পদে অবশ্য বিএনপি প্রার্থীর কাছে হার মানতে হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে। বিএনপি প্রার্থী ফারজানা বেগম ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট পেয়েছেন ২৮ হাজার ১৪৬ আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাজেরা বারী নৌকা প্রতীক নিয়ে ২৩ হাজার ৮৩০টি ভোট পেয়েছেন।
দলে বিদ্রোহ, নির্বাচনের আগে সংঘর্ষ সব মিলিয়ে ভোটের পরিবেশ উত্তেজনাকর হলেও শেষমেশ দুই উপজেলাতেই ভোট হয়েছে নির্বিঘ্ন ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনের আগে দুই উপজেলায় উত্তেজনা থাকলেও নির্বাচনের দিন সব উত্তাপ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। দুই উপজেলাতেই ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। ওসমানীনগরে ভোট দিয়েছেন ৪০ ভাগ ভোটার। বাকি ৬০ ভাগ ভোটারই তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে ভোটকেন্দ্রে আসেননি। আর জগন্নাথপুরে ৫৯ ভাগ ভোটারই কেন্দ্রে হাজির ছিলেন না। নতুন উপজেলা ঘোষিত হওয়ার পর প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হওয়ায় ওসমানীনগরের ভোট নিয়ে প্রথম দিকে ভোটারদের বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংঘর্ষে দুজনের প্রাণহানির ঘটনায় উৎকণ্ঠা ভর করে ভোটারদের মনে। যার প্রভাব পড়ে নির্বাচনের দিনে। অন্যদিকে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ না থাকায় জগন্নাথপুরের নির্বাচন শুরু থেকেই অনেকটাই প্রাণ হারিয়ে ফেলেছিল। ভোটের দিন এরই প্রভাব পড়ে।
সূত্র: মানবজমিন