কাওমি সনদের মান দেওবন্দের আদলে দিতে হবে: আল্লামা শফী

0
993
blank
blank

ঢাকা: বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতি ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী বলেছেন, এদেশে কওমি মাদরাসাসমূহ ভারতের দেওবন্দের নীতি আদর্শ মতে পরিচালিত হয়। কওমি সনদের ইস্যুসহ যেকোনো বিষয়ে দেওবন্দের নীতি আদর্শের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। দেওবন্দ যেভাবে পরিচালিত হয় সনদের মান নির্ধারণে দেওবন্দের নীতিমালা যেরকম এদেশেও কওমি মাদরাসা পরিচালনা করা এবং সনদের মান নির্ধারণ সেভাবেই হতে হবে।

তিনি বলেন, কোনো কোনো উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে যেনতেনভাবে এ স্বীকৃতি গ্রহণে অতি উৎসাহী ও অপতৎপরতা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে।

আল্লামা আহমদ শফী বলেন, কওমি আলেমদের মধ্যে জোরদার ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে কওমি মাদরাসার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।

কওমি মাদরাসা শিক্ষার সনদ বিষয়ে আজ সোমবার রাজধানীতে আয়োজিত উলামা মাশায়েখ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।

মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসা মাঠে সম্মেলনে অন্যান্য বক্তারা বলেন, দেশের ৮০ ভাগ কওমি মাদরাসা নিয়ে গঠিত বেফাককে বাদ দিয়ে কওমি সনদের ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তা যেকোনো মুল্যে প্রতিহত করা হবে। কোনো কোনো বক্তা মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও মাওলানা রুহুল আমিনের নাম উল্লেখ করে তাদের সমালোচনা করে বলেন, তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি নেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তারা আল্লামা শফীর আহুত বৈঠকে যোগ না দিয়ে মিথ্যাচার করছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

সম্মেলনের শুরুতে আল্লামা শফীর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তার প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।

লিখিত বক্তব্যে আল্লামা শফী বলেন, এদেশের কওমি মাদরাসা ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দেরই অনুসারী। দেওবন্দের মতই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ঈমান-আমল, আখলাক ও নৈতিক চিন্তাধারা গঠণে মৌলিক ভূমিকা পালন করে আসছে এবং কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চরিত্রবান দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরি করা এবং ইসলাম মহান বাণী সর্বস্তরের জনসাধারানের পৌঁছে দেয়াই কওমি মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। কওমি মাদরাসার সাথে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। এ মাদরাসাসমূহ সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্বশাষিত। দেওবন্দের অষ্ট মূলনীতিই হলো এ প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্দেশিকা। এ মূলনীতির অন্যতম হলো- এসব প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সরকারি সাহায্য গ্রহণ না করা ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকা।

আল্লামা আহমদ শফী আরো বলেন, গত দেড়শ’ বছর থেকে স্বাধীনভাবে চলে আসা কওমি মাদরাসাসমূহের শিক্ষা সনদের মান দেয়ার লক্ষ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারিসহ সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার পিছনে কারো কারো অতি মাত্রায় আগ্রহ সম্পর্কে আমরা কম-বেশি অবগত। কিন্তু এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই কারো কারো অতি উৎসাহমূলক তৎপরতা দেখে কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা, স্বায়ত্বশাসন অক্ষুণ্ণ রাখার বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা মনে করি, শত বছর ধরে চলে আসা কওমি মাদরাসার স্বকীয় নীতি আদর্শ, স্বাধীন শিক্ষাক্রম, পরিচালনা বিন্দু মাত্রও নষ্ট হবে না এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এমন নিশ্চয়তা পেলেই আমরা সরকার থেকে দাওরায়ে হাদীসের সনদের মান নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনায় বসতে পারি। অন্যথায় আমরা যেভাবে আছি সেভাবে থাকাই আমাদের জন্য নিরাপদ।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বেশ কিছু ধারা কওমি মাদরাসা স্বাধীনভাবে চলার পরিপন্থী, তারপরেও আমাদেরই কারো কারো অতি উৎসাহে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই চলছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নির্ণয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের জাতীয় কওমি উলামা মাশায়েখ সম্মেলন।

তিনি সম্মেলনে আগত উলামা-মাশায়েখগণকে ধন্যবাদ দিয়ে আগামীতেও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যের ডাক এলে সর্বাত্মক সাড়া দেয়ার আহবান জানিয়ে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মার কল্যাণ কামনায় দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির নামে কওমি মাদরাসা উৎখাতের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য এসব মাদরাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এই ধরণের নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো সিদ্ধান্ত জাতি গ্রহণ করবে না।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, কওমি আলেমদের এক জায়গায় বসে অনৈক্য দূর করতে হবে। সেই উদ্যোগ আল্লামা শফী নিয়েছেন এবং এখনো অব্যাহত আছে।

মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, আমরা সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন স্বীকৃতি চাই। সনদের নিয়ন্ত্রণ করবে কওমি আলেমরা, সরকার নয়।

মুফতি ওয়াক্কাস বলেন, বাংলাদেশে যারা সম্রাট আকবরের দরবারের আবুল ফজলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবেন তারা ধীকৃতি হবেন। কওমি মাদরাসা কওমি ওলামায়ে কেরামের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর বাইরে যাওয়া আত্মহত্যার শামীল হবে।

সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের মধ্যে রয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং তদালোকে প্রণীত শিক্ষা আইন ২০১৬-এর খসড়া অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে চক্রান্তমূলকভাবে বাদ দেয়া ইসলামী ভাবধারার গল্প, রচনা ও কবিতাসমূহ পুন: অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং হিন্দুত্ববাদী ও ইসলাম বিদ্বেষী কবিতা, গল্প ও রচনাবলী শিক্ষা সিলেবাস থেকে বাদ দিতে হবে। শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষাকে (যা ফরজে আইন) বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন পর্যালোচনা কার্যক্রমে দক্ষ ও বিজ্ঞ আলেমগণের পারমর্শ নিতে হবে। প্রস্তাবিত কওমি মাদরাসা শিক্ষনীতি-২০১২ এবং এর আলোকে তৈরিকৃত কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩ এর খসড়া বাতিল করতে হবে। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ এর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ও কমিটির সব কার্যক্রম বাতিল করতে হবে। যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নামে কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রতা বিলুপ্ত হয় এমন কোননো সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। পুরান ও নতুন মক্তব হাফেজিয়া ও কওমি মাদরাসা স্থাপন ও পরিচালনা সরকারি নিবন্ধনের আওতামুক্ত থাকতে হবে।

সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, শাইখুল হাদীস মাওলানা আশরাফ আলী, আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, শায়খুল হাদীস মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবীগঞ্জী, মাওলানা মোহাম্মদ তৈয়ব জিরী, মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, শায়খুল হাদীস মাওলানা নূর হোছাইন কাসেমী, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা আনোয়ার শাহ, মাওলানা মোস্তফা আযাদ, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদ, মাওলানা আবুল কালাম, মাওলানা আব্দুল হামীদ পীর সাহেব মধুপুর, মাওলানা মোবারক উল্লাহ বি-বাড়িয়া, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফিজ্জী, মাওলানা হিফজুর রহমান, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাওলানা আবুল কালাম, মুফতি মীযানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা সলীমুল্লাহ নাজীরহাট, মাওলানা আব্দুর রহমান হাফিজ্জী, মাওলানা মাহবুবে ইলাহী উজানী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, মাওলানা আনোয়ারুল করীম যশোর, মাওলানা নূরুল হুদা ফয়জী, মাওলানা তাজুল ইসলাম পীর সাহেব ফিরোজ শাহ, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুব, মুফতি কুতুব উদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা ইসমাঈল নূরপুরী, মাওলানা জোনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মুফতি হাবীবুর রহমান ফেনী, মাওলানা আব্দুল্লাহ সাভার, মাওলানা ইসমাঈল কিশোরগঞ্জ, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা আব্দুল আওয়াল, মাওলানা আব্দুল কাদের না:গঞ্জ, মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দীপী, মাওলানা লোকমান মাযহারী ও মাওলানা আযহারুল ইসলাম প্রমুখ।