গুম-খুনে বৈশ্বিক চাপে বাংলাদেশ

0
541
blank
blank

কূটনৈতিক প্রতিবেদক : গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে বৈশ্বিক চাপে আছে বাংলাদেশ। আগামী মে মাসে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউর (ইউপিআর) আওতায় তৃতীয়বারের মতো যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে তখন সেখানে গুম নিয়ে প্রশ্ন ওঠার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলেছেন, এ ধরনের পর্যালোচনার মুখোমুখি হওয়া বেশ কঠিন। কারণ অভিযোগগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক উত্তর দিতে হয় সরকারকে।

২০১৬ সালের পর্যালোচনায় বাংলাদেশকে ১৯৬টি সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সেগুলোর মধ্যে অন্তত ছয়টি গুমবিষয়ক। পেরু বাংলাদেশকে গুম থেকে সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ (সিপিইডি) ও নির্যাতনবিরোধী ঐচ্ছিক প্রটোকল (ওপি-সিএটি) সই করতে বলেছিল। আর্জেন্টিনা বাংলাদেশকে শরণার্থীবিষয়ক ১৯৫১ সালের সনদ ও এর প্রটোকল, সিপিইডি ও ওপি-সিএটি কার্যকর করার সম্ভাবনা বিবেচনার সুপারিশ করেছিল। যুক্তরাজ্য গুম-খুন ও সব ধরনের নির্যাতনের অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণসাপেক্ষে গুম, বিচারিক হেফাজতে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের বিচার করার সুপারিশ করেছিল। তিউনিশিয়া বাংলাদেশকে গুম থেকে সুরক্ষাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ এবং নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর শাস্তি, অমানবিক আচরণ প্রতিরোধে সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিল।

উরুগুয়ে সিপিইডি বাস্তবায়ন এবং সুইজারল্যান্ড বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমসংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছিল। এসব সুপারিশ বাংলাদেশ গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত নতুন করে তেমন কোনো আইনি উদ্যোগ নেয়নি।

২০১৩ সালে জেনেভায় ইউপিআরের আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রসঙ্গ উঠেছিল। একইভাবে প্রশ্ন উঠেছে গত ৬ ও ৭ মার্চ জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিতে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন (আইসিসিপিআর) বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনার সময়ও। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিভিন্ন অভিযানের সময় হতাহতের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হচ্ছে এবং কারো অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি হচ্ছে।

জেনেভায় অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় আইনমন্ত্রী দুই হাজার ৫১৬ জন র‌্যাব সদস্যের ব্যাপারে তদন্ত এবং দোষী প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর গুম প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের কোনো শব্দ নেই।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বয়ের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়ীদ রা’দ আল হুসেইনের আমন্ত্রণে গত শুক্রবার জেনেভায় তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। সেখানে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্বেগের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন তাঁরা। আইনমন্ত্রী জাতিসংঘের হাইকমিশনারকে বলেছেন, জাতিসংঘের দায়িত্বশীল সদস্য ও মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ তার নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশেষ করে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সুস্পষ্ট উদ্বেগ আছে পশ্চিমা দেশগুলোর। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নিয়মিতভাবেই এ বিষয়গুলো উঠে থাকে। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা গুম, বেআইনিভাবে আটক ও বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম অভিযোগ তুললেও সরকার এসব ঘটনা ঠেকাতে তেমন উদ্যোগ নেয়নি। গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ ‘গুমের সংখ্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে যাওয়া’র খবর তুলে ধরে যোগাযোগ করলেও বাংলাদেশ তাতে সাড়া দেয়নি।

গত ৬ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকেও বাংলাদেশের জবাব না দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। গত ২৪ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিতরণ করা ওই বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে কথিত গুমের নতুন নতুন অভিযোগ অব্যাহত থাকায় এবং এ বিষয়ে যোগাযোগ করলেও বাংলাদেশ পর্যাপ্ত জবাব না দেওয়ায় ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বিগ্ন। ’

গত ২০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তর প্রকাশিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সম্পৃক্ততায় গুম, নির্যাতন, বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ স্থান পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) গত ৬ জুলাই বাংলাদেশে গুমবিষয়ক প্রতিবেদন ‘তিনি আমাদের মাঝে আর নেই : বাংলাদেশে ঘটে চলা গোপন আটক ও গুমগুলো’ প্রকাশ করে। সেখানে এইচআরডাব্লিউ অভিযোগ করেছে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সাল থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীসহ কয়েক শ ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অজ্ঞাতপরিচয় স্থানে আটকে রেখেছে। এইচআরডাব্লিউর কাছে কেবল ২০১৬ সালেই অন্তত ৯০ ব্যক্তি গুম হওয়ার তথ্য রয়েছে। তাদের বেশির ভাগকেই কয়েক সপ্তাহ বা মাস আটক রাখার পর আদালতে হাজির করা হলেও এইচআরডাব্লিউ এমন ২১ বন্দির ঘটনা তুলে আনে যারা পরবর্তী সময়ে হত্যার শিকার হয়। এ ছাড়া আরো ৯ জনের অবস্থান এখনো অজানা।