গোপাল ভাঁড়, এক- এগারো ও মিডিয়া

0
1134
blank
blank

মিনার রশীদ: এক দিন সম্রাট তার পরিষদকে হুকুম করেন, গোপাল ভাঁড়ের উঠান মলত্যাগ করে ভরিয়ে দাও। সম্রাটের হুকুম তামিল করতে মন্ত্রী-সান্ত্রীরা মহা-উৎসাহে গোপালের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল।
সব শুনে গোপাল ভাঁড় বললেন, বেশ ভালো কথা। সম্রাটের হুকুম তামিল করো। কিন্তু মনে রেখো, সম্রাট তোমাদের হুকুম করেছেন শুধু পায়খানা করার জন্য, প্রস্রাব করতে বলেননি। কাজেই এক নম্বরটি করতে গিয়ে যদি কেউ দুই নম্বর কাজ করে বসো, তখন সম্রাটের হুকুম অমান্য করার দায়ে এই তরবারি দিয়ে প্রত্যেকের গর্দান কেটে ফেলব। বিষয়টির ‘টেকনিক্যাল জটিলতা’ উপলব্ধি করে সবাই একে একে ফিরে গেল। গোপাল ভাঁড়ের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে সম্রাট আরেকবার মুগ্ধ হলেন।
আদেশ জারি করা হয়েছে, একটি পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করে বিচার করা হোক। এই নির্দেশের মধ্যে কিছু গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। আগেকার দিনে সম্রাটদের কাজকর্ম নিয়ে কোনোরূপ প্রশ্ন করার সাহস প্রজাদের কারো হতো না। তবে গোপাল ভাঁড়ের মতো কিছু ভাঁড় অনায়াসেই সম্রাটদের সমালোচনা করতে পারতেন। সম্রাটকে বিভিন্ন কথা দিয়ে আটকিয়ে সম্রাট ও তার পারিষদকে বিনোদিত করতেন।
বর্তমান সরকার ও তাদের কাজকর্ম নিয়ে কিছু মিডিয়ার সমালোচনা বা প্রতিক্রিয়া দেখে সম্রাট ও গোপাল ভাঁড়ের মধ্যকার সম্পর্কের কথাটি মনে পড়ে যায়। প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে যখন সরকারের অস্তিত্ব ধরে টান পড়েছে, তখন জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে সরাতে সম্রাট ও গোপাল ভাঁড়ের নতুন এপিসোড শুরু করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
আমরা জানি, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে ‘এক-এগারো’র জরুরি সরকার। অন্য দিকে, এক-এগারোর সরকারকে যারা ক্ষমতায় এনেছিলেন, তাদের মধ্যে একই ঘরানার দু’টি পত্রিকার দু’জন সম্পাদকও ছিলেন। পরে কিছুটা চুপসে গেলেও এ কথা তখন তারা প্রকাশ্যে গর্ব করেই বলে বেড়াতেন। বিশেষ করে জরুরি সরকারের হানিমুন পিরিয়ডে তাদের এই তৃপ্তির ঢেঁকুর সবার নজর কেড়েছে। সেই জরুরি সরকারের কৃতিত্ব নেয়ার ইঁদুর দৌড়ে আজকের প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছিলেন, এ সরকার তাদেরই আন্দোলনের ফসল।
সেই হিসাব করলে এই দু’জন সম্পাদকের একজন হন বর্তমান সরকারের দাদাশ্বশুর ও অন্যজন হন নানাশ্বশুরের মতো। কৌতূহলের বিষয় হলো, মহামান্য সেই নানাশ্বশুরকে প্রধানমন্ত্রীর তনয় গ্রেফতার করে বিচারের দাবি উত্থাপন করেছেন। সাথে সাথেই জাতীয় সংসদ থেকেও একই রূপ দাবি তোলা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে মামলা করে বসেছে, অর্থাৎ তার ‘উঠান ভরিয়ে দেয়া’র হুকুম জারি হয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয়, কী বুদ্ধি প্রয়োগ করে এই ব্যক্তি নিজের উঠানকে রক্ষা করেন।
কোনো কোনো ব্যক্তি বেশি চালাকি করে নিজেদের অনেকটা বেমানান জায়গায় নিয়ে গেছেন। এখন আঘাত দিলেও অসহায়ের মতো আবারো সরকারের কৃপা ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কখনো গোপাল ভাঁড়ের স্টাইলে সরকারের বিরুদ্ধে একটি উচিত কথা বলে ফেললে পরক্ষণেই ইনিয়ে বিনিয়ে কয়েকটি স্তুতি দিয়ে কাফফারা দিতে হয়। এ প্রচেষ্টা সত্যিই করুণার উদ্রেক করে।
এখন তারা বলছেন, দেশের একটি গুপ্তচর সংস্থার কথামতো সংবাদ ছাপিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন।
এক-এগারোর সময়ের দু-একটি অপকর্মের কথা স্বীকার করা হয়েছে মাত্র। হঠাৎ এটা করার উদ্দেশ্য নিয়েও ওয়াকিবহাল মহলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
বিরোধীদলীয় জোটের বিরুদ্ধে এরকম শত শত অপকর্ম ছড়িয়ে আছে। মাঝখান থেকে হঠাৎ দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করে দোষ স্বীকার এবং সেটাকে নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া গোয়ালার টক দইয়ের উপাখ্যান স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ওই মতলববাজির মূল শিকার কে হয়েছিল, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। পুরো ব্যাপারটিতে কিছুটা ব্যালান্স সৃষ্টির জন্যই বোধহয় এ দেশের সর্বপ্রধান রাজনৈতিক দলের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্বের সম্পর্কেও বানোয়াট সংবাদ ছাপানোর কথা স্বীকার করা হয়েছে।
বসুন্ধরার মালিকের কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন বলে যে শিরোনামটি তিনি করেছিলেন, আজ স্বীকার করছেন যে তা যাচাই-বাছাই না করেই ছাপানো হয়েছিল। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম দিকপাল হিসেবে গণ্য এই ঝানু সাংবাদিক নিজেকে নির্দোষ দেখাতে চেয়েছেন।
কিন্তু এর ফলে জাতির কী সর্বনাশ করা হয়েছে তা উপলব্ধির মতো প্রজ্ঞা তাদের কোনো দিন হবে কি?
গুটি গুটি পা পা করে যে দেশটি গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখান থেকে কারা আজ বর্তমান করুণদশায় দেশটিকে পৌঁছে দিয়েছেন? দেশের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার নামে আগের চেয়ে আরো জটিল করে ছেড়েছেন কারা? দু’টি রাজনৈতিক দলের একটিকে তারা বাঘের পিঠে চড়িয়ে দিয়েছেন। এক দল দিয়ে এখন অন্যটিকে নিস্তেজ ও বিলুপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তারা যখন মাইনাস টু ফর্মুলায় অগ্রসর হয়েছিলেন, তখন এই অধম তার এই নগণ্য কলাম নিয়ে সে প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কারণ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কাউকে মাইনাস করার পরিণাম কখনো শুভ হয় না। কাউকে মাইনাস করতে হলে তা করবে দেশের জনগণ। অন্য কারো প্রেসক্রিপশনে তা করতে গিয়ে কোনো জাতি তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না।
বেশ কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এ দেশে গণতন্ত্রের অন্যতম বড় উপাদান হিসেবে দু’টি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হয়েছে। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক মানস কিছুটা ব্যতিক্রমী। অবশ্য কোনো স্থিতিশীল রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি এ দেশে একটু কঠিন। পাঁচজন সমর্থক নেই এমন দলও পাঁচ ভাগ হয়ে পড়েছে। এরশাদের এমন অনুগত স্ত্রীও শেষমেশ তার রাজনৈতিক আনুগত্য মানতে অনীহা দেখিয়ে চলছেন।
এ অবস্থায় পরস্পরের মুখোমুখি দু’টি শক্তিশালী দলের সৃষ্টি এ দেশে আশীর্বাদ হিসেবে দাঁড়াতে পারত। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিকাশের একটা পর্যায় পর্যন্ত কথিত পরিবারতন্ত্র আমাদের জন্য অভিশাপ না হয়ে কিছুটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিতে পারে। ইন্ডিয়ার মতো ম্যাচিউরড গণতন্ত্রও পরিবারতন্ত্র থেকে ফায়দা নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলোÑ যে সিপাহসালাররা এই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ শুরু করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ নিজের পরিবারকে সামনে নিয়েই সেই জিহাদে শামিল হয়েছিলেন।
এ দেশে বিরাজনীতিকরণের তথাকথিত এক-এগারোর সেই মিশনটি এখনো থেমে নেই। একটি রাজনৈতিক দলকে বিষ খাইয়ে এবং অন্য দলটিকে মিঠাই খাইয়ে পুরো রাজনীতিকে পিষে মারার ব্যবস্থা চলছে।
মজার ব্যাপার হলো- যারা আজ বাঘের পিঠে চড়েছেন এবং যারা চড়িয়েছেন, উভয়েই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন একই কমান্ড সেন্টার থেকে। মূলত বিরাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে দেশটিকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে রাখাই এই সেন্টারের মূল উদ্দেশ্য। ফলে সেই কমান্ড সেন্টারের নির্দেশে কেউ সম্রাট সাজে, কেউ সাজে গোপাল ভাঁড়।
এই প্রভুরা নিজেদের দেশে গণতন্ত্রকে দিন দিন শক্তিশালী করে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা আমাদের গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ পেতে দিচ্ছে না। তজ্জন্য কারো মগজে বাকশালের বীজ কিংবা কারো মনে অন্য ফোবিয়া ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর এদেরই হাতের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের রঙ-বেরঙের কিছু ব্যক্তি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে এদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে- এর জন্য সুশীল গংকে ব্যবহার করে ‘উদ্দীন’দের মাধ্যমে সেটাকে প্রথমে বিকৃত ও বিকলাঙ্গ করা হয়েছে। পরে সেই অজুহাত দেখিয়ে আদালতকে ব্যবহার করে অন্য গ্রুপটির মাধ্যমে তাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে দু-একজন সম্পাদকসহ কিছু ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিরাজনীতিকীকরণের এজেন্ডা কিভাবে এগিয়ে নেয়া হয়েছে, দেশের রাজনীতিবিদদের চরিত্র কিভাবে ও কেন হনন করা হয়েছে, সেসব ঘটনা। প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে দেশে যে দারুণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তাকে ধূলিসাৎ করতে ব্যবসায়ীদেরও চরমভাবে নাজেহাল ও হেনস্তা করা হয়েছে। দেশরক্ষা বাহিনীর একটিকে অন্যটির মুখোমুখি করে তাদের মনোবল চিরতরে ধ্বংস করা হয়েছে। অর্থাৎ টার্গেট করা হয়েছে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; এই তিনটিকেই যুগপৎ তছনছ করে ছেড়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক কালচার যতই খারাপ হোক না কেন, এত দিন দু’টি দল বা জোট একত্রে দেশের মধ্যেই অবস্থান করতে পারত। ‘এক-এগারো’র পর পরিস্থিতি এমন করা হয়েছে, একটি দল দেশে থাকলে অন্যটি দেশে থাকতে পারবে না। এসবই আজ কথিত সুশীল গং-এর কৃতিত্ব, এসবই আজ তাদের কাজের সফল পরিণতি। প্রভুর দেয়া মিশন তারা যথার্থই বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন।
বিচারপতি মানিক প্রকাশ্যে বলেন, প্রধান বিচারপতিকে তিনি মানবেন না। গণজাগরণের ইমরান বলেন, তার কারণেই কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। তাদের এসব কথায় আজ আর আদালত অবমাননা হয় না!
মানবতাকেও খণ্ডিত ও বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। কান্না শুরুর আগে এই মানবতাবাদীরা ভালো করে লাশের চেহারা দেখে নেন।
নিজেদের মধ্যে টক দইওয়ালা ও গৃহস্থের মধ্যকার নাটকটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের আটকের ঘটনায়। এ মজলুম সম্পাদককে মাসের পর মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হলেও এ দেশের গণমাধ্যম টুঁ শব্দও উচ্চারণ করছে না। সব মামলায় জামিন পেলেও তাকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে কারো মধ্যে উসখুসও লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর জন্য সম্পাদকেরা বিবেকের সামান্য দংশনও অনুভব করছেন না কেন?