চাপা আতঙ্কের মধ্যে বাকস্বাধীনতা

0
1365
blank
blank

সালমা বেগম: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন অনিরাপদ। কোনো বিশেষ শ্রেণী নয় বরং সব গোষ্ঠীর মানুষই আজ নিরাপত্তাহীন। সবচেয়ে যেটা বিস্ময়ের সেটা হচ্ছে আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে আমরা ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দিতে পারব না। তাহলে তারা কোথায় নিরাপত্তা দেবেন? মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অলি আহাদের কন্যা রুমিন ফারহানা বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিয়েও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর মূল অপরাধী কোনো দিনও ধরা পড়বে না। কারণ একটা ঘটনা ঘটার এক মিনিটের মাথায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটি বিশেষ দলকে দায়ী করা হয়। তদন্ত হয়নি, অনুসন্ধান হয়নি, পুলিশ ইনভেস্টিগেশন তখন শুরুও করেনি। এমনকি ডেড বডির সুরতহাল হয়নি। তার আগেই আপনি দায়ী ব্যক্তি ঠিক করে ফেললেন। তাহলে কিভাবে দোষী শনাক্ত করবেন। বিচার কোনো দিনও হবে না। গত সাড়ে তিন মাসে ১৫০০টা খুন হয়েছে। কিন্তু কয়টার বিচার এ পর্যন্ত হয়েছে। আমরা এখন ঝগড়া করছি আইএস আছে, না আইএস নেই। আলকায়দা আছে, না আলকায়দা নেই। সরকারের মন্ত্রীতো বলছে আলকায়দা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আট হাজার জঙ্গি বাংলাদেশে এখন আছে। জঙ্গি আছে নেই- এক জটিল কথা আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি না। আমরা নিরাপত্তা চাই। তিনি বলেন, সরকার বৈধ হোক বা অবৈধ হোক সে যখন নিজেকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলে কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন, অল্প গণতন্ত্র কিংবা সীমিত গণতন্ত্র তখন বোঝা যায় যে বাংলাদেশের অবস্থাটা আসলে কি।

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া বা হাজারো মানুষের বাক-স্বাধীনতা একটা চাপা আতঙ্কের মধ্যে আছে। আমরা শুধু একটা স্বৈরাচারী সরকারের হাতেই পড়িনি, আমরা একটা একনায়কতান্ত্রিক এক দলীয় সরকারের হাতে পড়ে গিয়েছি। তারা একটা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ প্রপাগান্ডা দিয়ে তারা যেকোনো কিছুকে জায়েজ করতে চাচ্ছে। ভোটের অধিকারের কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, ন্যায়বিচার, সুশাসন, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেন তাহলে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত। তিনি বলেন, টকশোতে যাওয়ার কারণে আমাকেও নানা হুমকির মুখোমুখি হতে হয়। আমি আমার জান, সম্মান, আমার পরিবারের নিরাপত্তা সমস্ত কিছু বাজি রেখে সত্য কথা বলি, টকশোতে যাই। তারা যে শুধু আমাকে নিয়ে কথা বলেছে তা না। তারা আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলেছে, আমার পরিবারকে নিয়ে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। এ সরকার দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র প্রপাগান্ডার ওপর। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতা তো ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা। ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য এটা একটা বিকৃত পন্থা। কারণ আজকে যদি একটা ফেয়ার ইলেকশন হয় তাহলে দেখা যাক কে আসে। যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করা হয়েছে সেই কারণে এই জঙ্গির উত্থান। তিনি বলেন, বিএনপির দায় এতটুকু যে, রাজনীতিটা যে বদলে গেছে সেভাবে বিএনপি নিজেকে বদলাতে পারেনি। কেন বলছি, একটা সময় ছিল যদি আপনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন আপনাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আমার বাবা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অধিকাংশ সময় জেলে ছিলেন। শুধু তাই নয় স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আমার বাবাকে ইজ্জতের সঙ্গে জেলে নিয়ে যাওয়া হতো। পুলিশ আসত আমার বাবা উঠতেন, নামাজ আদায় করতেন, নাস্তা করতেন তারপর নিয়ে যেতেন। উনাকে নিয়ে রিমান্ডে দেয়া এগুলো আমরা কল্পনাও করিনি। আর এখন দেখামাত্র গুলি কর। এ সংস্কৃতি তো ভিন্ন সংস্কৃতি, এরকম দস্যু সংস্কৃতি তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিল না। এটা তো নতুন। বাংলাদেশের মানুষ এখন বাঁচার প্রত্যাশা ছেড়ে দিয়েছে। তারা ধরে নিছে যেকোনো সময় তাদের মৃত্যু হতে পারে। তারা এখন লাশের অপেক্ষা করে লাশটা যেন পাই। যাতে জানাজা করতে পারে, কবর দিতে পারে। বিএনপির কাউন্সিল হলো নতুন নেতারা আসছেন, এখনও অনেকগুলো পদ বাকি। পুরো কাউন্সিল গঠন হওয়ার পর বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নীতিনির্ধারক মহলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ ধরনের সরকারের মুখোমুখি তারা কিভাবে হবে। বিএনপি প্রচারে খুব দুর্বল যেটা আমার সবসময় মনে হয়। প্রপাগান্ড তো অনেক দূরের কথা বিএনপি নিজের শক্তিটাই প্রচার করতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখন যেভাবে দুই ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে সেটা আমি জানি না পাকিস্তান আমলেও হয়েছে কিনা এতটা বিভাজন। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বাংলাদেশের কেউ নেই। যেকথা আজকে আমি পরিষ্কার বলছি, ১৬ কোটি মানুষের কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে না, কেউ স্বাধীনতার বিপক্ষে না এবং বিশেষ করে আমরা যারা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ১০-১২ বছর পর যাদের জন্ম আমরাতো বাংলাদেশকেই বিশ্বাস করি আর কিছু আমরা চিনি না। কিন্তু আমাদেরও যেভাবে বিভাজনের চেষ্টা করা হচ্ছে, নতুন প্রজন্মকে যেভাবে বিভাজনের চেষ্টা করা হচ্ছে এ মহাপাপ থেকে জাতিকে বাঁচানো উচিত। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল বাংলাদেশে ব্রিলিয়ান্ট মানুষ রাজনীতি করতেন। অলি আহাদ জীবনে কোন দিন দ্বিতীয় হননি। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি প্রথম হয়েছেন। কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়ে আজকাল রাজনীতিতে আসে না। রাজনীতিকে এখন ধরে নেয়া হয়েছে বিনা পুঁজির ব্যবসা। রাজনীতি করবা টাকা কামাবা। ঠিক যেমন গার্মেন্ট ব্যবসা, জুতার ব্যবসা, মাছের ব্যবসা রাজনীতিও একটা ব্যবসা। বর্তমানে পার্লামেন্টে ৭০ ভাগ ব্যবসায়ী। এভাবে চলতে পারে না- এটার গুণগত পরিবর্তন দরকার। এবং আমি মনে করি এটার গুণগত পরিবর্তন হবে। একটা ট্রানজিশনাল সময় দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এ সময়টা কাটতে কয়েক বছর লাগবে। তারপর আমি বিশ্বাস করি একটা পরিবর্তন হবে। আমি এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, যেখানে আমি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পাব, আমি আমার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা করতে পারব, এমন একটি বাংলাদেশ হবে যেখানে আমি আপনার মতের সঙ্গে একমত নাই হতে পারি কিন্তু আপনি যাতে আপনার মতপ্রকাশ করতে পারেন সেটার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করব- আমি এমন বাংলাদেশ চাই।