জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধরন

0
69
blank
blank

সাকিব সাদমান:

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল মতে, নতুন বছরে জাতীয় সংসদের আরো একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন একটি নাটক কিনা, ইতোমধ্যে সে প্রশ্ন উঠেছে। কেন এহেন প্রশ্ন!
গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন মানেই ভোটের উৎসব। অথচ এই দেশে অর্ধেক মানুষ ভোটে আর অর্ধেক মানুষ ভোটের বাইরে। দুই বড় দলের একটি ভোটে, অন্যটি জেলে বা দৌড়ের উপরে। নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আদতে একটি নিরেট প্রতিযোগিতা। নির্বাচন মানেই দুই বা ততোধিক দল বা প্রার্থীর লড়াই। যথাযথ নির্বাচন মানেই পূর্বপরিকল্পিত নিশ্চিত ফলাফল নয়- এমনকি, কোনো জরিপও পুরোপুরি মিলে যায় না। মঞ্চে নাটক করা সহজতর। কিন্তু নির্বাচনের ময়দানে নাটক মঞ্চায়ন যথেষ্ট কঠিন। এই মাঠে প্রথমেই দরকার হয় মোটামুটি সমান প্রতিপক্ষ। নির্বাচনে সমান সমান প্রতিপক্ষ না হলে সেটির ভাগ্যে জুটে যায় একতরফা নির্বাচনের অভিধা। প্রতিযোগিতা না থাকলে ফলাফল আগেই নিশ্চিত হওয়া যায়, দু’টি দলের খেলার ফলাফল আগেই স্থির হয়ে গেলে সেই খেলায় মজা থাকে না, উৎসব তো দূরঅস্ত। আগামী নির্বাচনটি ব্রাজিলের সাথে আফগানিস্তানের ফুটবল খেলার মতোই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। আবার প্রতিপক্ষ মাঠে আসেনি বলে আবাহনী ফুটবল টিমকে দুই ভাগ করে মাঠে নামিয়ে খেলতে দিলেই বা কেমন খেলা হতে পারে! অন্যদিকে নির্বাচনের আগেই ফলাফল নিশ্চিত বলে দিতে পারলে সেটিকে আদৌ নির্বাচন বলা যাবে কিনা, সেও এক প্রশ্ন।

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ২৯ দল এবং সেই সাথে স্বতন্ত্র শ’ চারেক (কমবেশি) প্রার্থী নির্বাচনে যাচ্ছেন। বাছাইয়ের পর এখন প্রার্থী সংখ্যা এক হাজার ৯৮৫। বাতিল থেকেই আপিল-অন্তে প্রার্থী সংখ্যা বাড়বে। আবার প্রত্যাহারের পরই চূড়ান্ত হবে প্রার্থী তালিকা। ২৯টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের জোটেই আছে ১৪টি দল। বাকি দলগুলো আওয়ামী জোটের শরিক না হলেও সমমনা। অন্যদিকে নির্বাচনে ইসলামী দলের প্রার্থী ৪৪৭ হলেও প্রধান ইসলামী দল নির্বাচনকে ‘না’ বলে দিয়েছে। ভোটের বিবেচনায় প্রধান ইসলামী দল যথা- জামায়াতে ইসলামী (নিবন্ধনহীন), ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস নির্বাচনে যাচ্ছে না। এই পাঁচ দল ২০১৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করেছিল। নিবন্ধিত সাতটি ইসলামী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এই সাতটির মধ্যে ত্বরিকত ফেডারেশনের (জোটসঙ্গী) গত দু’টি সংসদে প্রতিনিধি ছিল- যা আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করেই প্রাপ্ত। বাকি ছয়টি তথা বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি অতীতে সংসদীয় আসন পায়নি এবং তাদের মধ্যে অতীতে অংশগ্রহণকারী দলের ভোটের হার নগণ্য। আওয়ামী লীগের ভাষায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতার খেতাব দিতে এই দলগুলো এক-দু’টি আসন পেয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দল এবং সাতটি ইসলামী দল ছাড়াও ৮-৯টি দল এবারের ভোটে নেমেছে। এদের মধ্যে জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম, কল্যাণ পার্টি রয়েছে।
স্বৈরাচারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে মান্যতা পায়। এর মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচন নির্দলীয় কেয়ারটেকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও বড় দল বিএনপির জোরালো ওজর-আপত্তি ছিল। বাইরের হস্তক্ষেপের কথাও ওঠে। ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ১৯৯১ সালে বাকশাল (৫), কমিউনিস্ট পার্টি (৫), ইসলামী ঐক্যজোট (১), ন্যাপ-১ (মোজা), গণতন্ত্রী পার্টি (১), ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (১), জাসদ-১ (সিরাজ), ওয়ার্কার্স পার্টির (১) সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৯৬ (জুন) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ (রব) একটি করে আসন পেয়েছিল। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ইসলামী জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট (১৪), ইসলামী ঐক্যজোট (২), কৃষক শ্রমিত জনতা লীগ (১), জাপা-১ (মঞ্জু), সংসদে আসন পেয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র বাদে প্রায় ৮০টি, ১৯৯৬ (জুন) নির্বাচনে ৯০টি (কমবেশি), ২০০১ সালে ৫৭টি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

নির্বাচনের ঢোল বাজার শুরুতেই অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য এবং একটু পরেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রব ওঠে। সরকার, সরকারি দল ও বিরোধী দল, কারোরই এ নিয়ে আপত্তি ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রও প্রথম থেকে এটি চেয়ে আসছে। পরে সরকারের তরফে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নতুন বয়ান দেয়া হয়। বলা হয়, জনগণের অংশগ্রহণই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, অর্থাৎ রাজনৈতিক দল নয়, ভোটার এলেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। সুধীজন ও অংশীজনের একাংশ বলছে, কেবল ভোটারের অংশগ্রহণে একটি ভালো নির্বাচন হতে পারে না। তাদের দাবি, প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে বিপুলসংখ্যক ভোটার কেন্দ্রেই যাবে না। এই ভোটাররা পছন্দের দল বা মার্কা পাবে না বলে ভোটদানে বিরত থাকবে। এ কথায় যুক্তি আছে।
১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ সালে কেবল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ৩০.০৮-৩০.৮১, ৩৭.৪৪-৩৩.৬১, ৪০.১৩-৪০.৯৭ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ভোটে না এলে এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটার নির্বাচনে নেই। এর সাথে যুক্ত হবে শরিক বা সমমনা দল। তাতে একটি মাত্র দল আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি ভোটে না এলে ভোটের দিনে ৫০ শতাংশ ভোটারের দেখা মিলবে না। ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ১২.১৩, ৮.৬১ ও ৪.২৮ শতাংশ। নির্বাচন মানে একাধিক দল থেকে পছন্দমতো একটি বেছে নেয়া। ৫০ শতাংশ ভোটারের মার্কা বা দল অনুপস্থিত থাকলে পছন্দমতো বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না। এখানে ২৯টি দলের অংশগ্রহণ নিতান্তই পানসে। কেননা, গোটা দু’দল ছাড়া বাকিদের ভোটের হার নগণ্য। সুতরাং এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের কথিত বয়ানে অংশগ্রহণমূলক তকমা পাবে কিনা, সে প্রশ্ন থাকবেই। দি¦তীয়ত, নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিরোধী দলশূন্য অবস্থায়। বিরোধিতার বিন্দুমাত্র স্পেস থাকবে না এ নির্বাচনে। ২৯ দলের সব ক’টিই আওয়ামী লীগের সমমনা, ১৪টি খোদ জোটসঙ্গী। একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলশূন্য জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে। এ নির্বাচন সম্প্রতি কম্বোডিয়ার নির্বাচনী মঞ্চায়নের মতোই বিবেচিত হতে পারে।

সমমনা দল, আওয়ামী লীগের ডামি বা বিকল্প প্রার্থী কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার খোলস পরানোর নাটকের মহড়া চলছে। যাদের কেউ চেনে না, সংসদে আসন পায়নি, সর্বোচ্চ এক-দুই শতাংশ ভোট পেতে পারে, তাদের সাথেও আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সভা হয়েছে ও হচ্ছে। জোটসঙ্গীদের তোয়াজ-তোষণ অব্যাহত আছে। মুরগি ধরার মতো করে বিএনপি থেকে লোক বাগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি জোট থেকে ছুটে যাওয়া এবং গত নির্বাচনে ১ শতাংশেরও কম ভোট পাওয়া কল্যাণ পার্টিকেও খুদ-কুঁড়ার ভাগ দেয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। বিএনএম-তৃণমূল বিএনপির কতিপয় জনবিচ্ছিন্ন-জনধিকৃতের সাথেও আওয়ামী লীগের দরকষাকষি করতে হচ্ছে। ২০১৪-এর বিনাভোটের জয়ের কলঙ্ক ঘোচাতে সর্বত্র ডামি প্রার্থীর আয়োজন রাখতে হচ্ছে- এই প্রার্থীদের কেউ কেউ মূল নৌকার প্রার্থীকে চোখ রাঙিয়ে হুঙ্কারও দিচ্ছে। এদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এত বড় পুরনো ও সংগঠিত দলটিকে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগে এই বেসামাল অবস্থার সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না। একজন ইউটিউবার প্রায়ই বলেন, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নামক দলটির বস্তুত মৃত্যু ঘটেছে। তার মতে, সবচেয়ে বড় পুরনো সুসংগঠিত দলটি জনভোটারের মুখোমুখি না হয়ে সরকারি মেশিনারিজ ব্যবহার করে আগের রাতে ভোট সম্পন্ন করেছে। আরেক জনকে বলতে শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর আসনেও দলটি ভোট করতে সাহস করেনি। একটি দলের জন্য এর চেয়ে বড় দেউলিয়াপনা আর কী হতে পারে! এই একই লোকেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, প্রতিযোগিতাশূন্য, অর্ধেক ভোটারহীনতার নির্বাচনকে কী বলবে? আওয়ামী ঘরানার সবাই ভোট দিতে যাবে কিংবা এই ৫০ শতাংশ ভোটারের সবাই বেঁচে আছে অথবা দেশেই তথা ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থান করছে, সেটিও না। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় অনেকেই ভোটের দিন কেন্দ্রমুখী হতে চাইবে না। তবে নতুন ভোটাররা কোনদিকে যাবে, তা অবশ্য দেখার বিষয়। কেউ কেউ বলছেন, বিগত তিনটি নির্বাচনে নতুন ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি বলে এবার খুব উৎসাহ নিয়েই ভোট দিতে যাবে। আবার কেউ কেউ ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১-এর নির্বাচন দেখিয়ে বলছে, নিকট অতীতের ক্ষমতাসীনরা প্রতিবারেই হেরেছে- ফলে নতুন ভোটাররা কতভাগ ভোট দিতে যাবে তা নিয়ে দ্বিধা আছে।
তবে যাবতীয় কিছু দেখে মনে হতেই পারে, উপরের সব কিছু ছাপিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ দারুণভাবে সফল হয়েছে- এটিই কি দলটির সাধারণ সম্পাদকের সেই খেলা! খেলা কিন্তু আরো আছে। ভোটার উপস্থিতির খেলা। আওয়ামী লীগ বুঝেছে যে, মুরগি ধরা আর ডামি প্রার্থী নিয়ে নির্বাচনকে কাক্সিক্ষত মানে নিয়ে যাওয়া দুরূহ। এখন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির জন্য তিনটি খেলার সুযোগ আছে। প্রথমত, কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া ভোটারের সংখ্যা সততার সাথে প্রদর্শন করে বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া যে, বিএনপির সন্ত্রাসের ভয়ে ভোটার আসতে পারেনি, এই অজুহাত দাঁড় করানো সহজ হবে।

দ্বিতীয়ত, ভোটার সংখ্যা যাই-ই হোক, সেটিকে বাড়িয়ে দেখানো; ৩০ শতাংশকে ৬০ শতাংশ বলে চালিয়ে দেয়া। এটিও কঠিন হবে না। তৃতীয়ত, জোর করে ভোটারদের কেন্দ্রে হাজির করা। এ ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, অর্থপ্রদানের ঘটনা ঘটতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। এলাকার নেতাকর্মীরা জানে, কোন কোন বাড়ির ভোটার নির্ধারিত মার্কা নেই বলে ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ভোটের সময় এরাই আওয়ামী লীগের টার্গেটে পরিণত হতে পারে। এতে সরকারি যন্ত্রাদিও ব্যবহৃত হতে পারে। যারা এমন আশঙ্কা করছেন, তাদের ধারণা কেবল ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির ১০-১৫ হাজার নেতাকর্মী জেলে ঢোকানো, ৪০ লাখের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা দায়ের, দেড় হাজারকে ভুয়া মামলায় সাজা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে রাখার চেয়ে গ্রামের কেবল সমর্থক ধরনের ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রে নিয়ে আসা অনেক সহজ হবে।

জানি না, এই তিন খেলার কোনোটি আওয়ামী লীগ আদৌ খেলবে কিনা। সেটা যথাসময়ে দেখা যাবে।

[সূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত]