ছলিম উল্লাহ মেজবাহ:
বিলুপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ নামে আর কোনো দল থাকছে না। নতুনভাবে আসবে তারা রাজনীতির মাঠে। যে কোনো সময় আত্মপ্রকাশ করতে পারে নতুন নামে। দলের নেতারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে চলতি মাস বা আগামী মাসে আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা এবং দলের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের কারণে জামায়াত রাজনীতিতে সবসময় বিতর্কিত। ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই জামায়াত প্রবল চাপে রয়েছে। দলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। আরো দুই নেতার ফাঁসির রায় হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একজন ভোগ করছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে ২০১০ সালে আন্দোলনে নেমেও সফল হতে পারেনি জামায়াত।
জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, দল বিলুপ্ত হওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা আত্মপ্রকাশ করবে। রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য নাম হবে জাস্টিস পার্টি। এই দলে শুধু জামায়াতের বর্তমান নেতাকর্মীই নয়, অন্যান্য দল থেকেও সমমনা রাজনৈতিকদের নেয়া হতে পারে। নতুন দল গড়ার বিষয়টি মজলিসে শূরার একাধিক সদস্য মানবকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। কোনো-কোনো নেতার ভাষ্য চলতি বছরেই নতুন সংগঠনের দেখা মিলতে পারে। জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক, সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান নতুন দল গঠনের ব্যাপারে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি।
এদিকে চলতি বছরের প্রথম থেকে নতুন নামে দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জামায়াতে ইসলামীতে। ২০০৯ সালেও একই প্রস্তাব করেছিলেন দলটির কয়েকজন নেতা। তখন তা দলীয় ফোরামে অনুমোদন পায়নি। আগে বিরোধিতা করলেও এবার নতুন নামে দল গঠনের প্রস্তাব এসেছে জামায়াতের মজলিসে শূরা থেকেই। প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলের নির্বাহী পরিষদকে। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে জামায়াতের রক্ষণশীল অংশ সংস্কার ও নতুন নামে দল গঠনের বিরোধিতা করলেও এবার দলের সর্বস্তরের নেতাই এতে একমত। গত ৯ বছর জামায়াতের ওপর চলা দমনপীড়ন থেকে বাঁচতে এ ছাড়া আর পথ নেই বলেও মনে করেন তারা। অপরদিকে মজলিশে শূরার প্রস্তাব রয়েছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৬ (৪) ধারা স্থগিত রাখার। ৬ ধারায় জামায়াতের চারটি স্থায়ী কর্মসূচি বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম তিনটি কর্মসূচি ধর্মীয়। ৬ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সত্ ও চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা। এ ধারা স্থগিত হলে জামায়াত ভোটের রাজনীতি থেকে স্থায়ীভাবে সরে যাবে। দলটির সূত্র জানিয়েছে, এ ধারা স্থগিত হলে জামায়াত রাজনৈতিক দল থেকে একটি ধর্মীয় সংগঠনে পরিণত হবে। নতুন নামে দল গঠন করা হলেও জামায়াত ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে থেকে যাবে। দ্বীনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাবে।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, আপাতত তারা নীরব থাকবে। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে থাকবে না। দ্বীনি দাওয়াতের কার্যক্রম জোরদার করা হবে। থাকবে না মিছিল-মিটিংয়ের রাজনীতিতেও। নতুন নামে দল গঠনের প্রস্তাবের কথা স্বীকার করেছেন দলটির কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব যোবায়ের। তিনি সাংবাদিকরদের বলেছেন, জামায়াত একটি বড় দল। দলে অনেক ধরনের প্রস্তাব, চিন্তা থাকে। দলের শীর্ষ নেতারা আলোচনা করে ঠিক করেন, কোনো প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হবে, কোনটি বাতিল করা হবে।
অন্যদিকে দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাচাইতে পারে!। গত দুইদিন আগে জামায়াতের মজলিসে শূরার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও সূত্রটি অসমির্থত। সূত্রটি জানায়, একইদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত বিলুপ্তির ঘোষণা আসতে পারে। তবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও জামায়াত একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে থাকবে। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এটি বিলুপ্ত হবে। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সারাদেশে জামায়াতের নেতাকর্মীর মতামতের ভিত্তিতে মজলিসে শূরা কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ’৭১ সালে জামায়াত ইসলামীর ভূমিকার জন্য তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এই ক্ষমা প্রার্থনার দিনটি তারা বেছে নিতে পারে ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের দিনটি। ওইদিনই জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি, ভিডিও বার্তা বা অন্য কোনোভাবে একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইবে। তবে এই ক্ষমাটা নিঃশর্ত ক্ষমা নয়। ক্ষমা চাওয়ার আগে জামায়াত একাত্তরে তাদের ভূমিকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করবে এবং কেন তাদের এ পরিস্থিতিতে যেতে হয়েছে সে ব্যাখ্যা দেবে। দলের ঢাকা মহানগরের নেতারা জানিয়েছে, নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা জামায়াত করেন ও জামায়াতের সমমনা ব্যক্তি, গোষ্ঠীকে নিয়ে জামায়াত হয়তো নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবে। সেটার সঙ্গে জামায়াত বিলুপ্তির কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াত বিলুপ্তি হলেও জামায়াতের যে স্বগোক্তি, জামায়াতের যে নিজস্ব ভবন, সম্পত্তি এবং আর্থিক বিষয়গুলো আছে সেগুলো চ্যারিটির কাজে ব্যবহার করা হবে। এগুলো হাসপাতাল, এতিমদের উন্নয়নসহ নানা চ্যারিটেবল কাজে ব্যবহার করা হবে বলে জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর সারাদেশে যে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জেলে আছেন তাদের জন্য জামায়াত বিলুপ্ত হলেও একটি বিশেষ তহবিল গঠন করবে। জামায়াত তাদের আইনি সহায়তাসহ অন্য সুবিধাদি প্রদান করবে। এ ছাড়া বিলুপ্ত হওয়ার পর জামায়াতের প্রত্যেকটা কর্মী বিশ্ব ইসলামী উম্মার জন্য কাজ করবে এবং যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে। তবে মজার ব্যাপার হলো এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের ভূমিকার জন্য যেসব জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় সেসব যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে জামায়াত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এখনো জামায়াতের ওয়েবসাইটে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধাপরাধীদের শহীদ হিসেবে গণ্য করে এবং তাদের বীরের মর্যাদা দেয়।
সাবেক সচিব শাহ হান্নান পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী আর বাংলাদেশ জামায়াত এক নয় বলে উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার সময়ের ভূমিকার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। এর পরও দলের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বায়তুল মোকাররমে জামায়াতের বিশাল জনসভায় ১৯৭১ সালে জামায়াতের সে সময়ের রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রয়োজন মনে করা হলে এখন আবারো ক্ষমার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
জামায়াতের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে শাহ হান্নান সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলের কিছু ঐতিহাসিক নাম রয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রয়েছে। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীও ভারত পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কায়ও রয়েছে। ১৯৭৯ সালে এখানে যে জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি নতুন জামায়াতে ইসলামী। একেবারে অল্পসংখ্যক রয়েছেন যারা স্বাধীনতা-পূর্ব জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, রাজনৈতিক বাস্তবতা এসব কিছু মেনে নিয়েই জামায়াত এখানে কাজ করছে। জামায়াতের বিলুপ্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এরপরও জামায়াত হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে পারে। ইসলামের প্রচার ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ দলের নতুন লক্ষ্য হতে পারে। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সম্প্রতি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এই সিদ্ধান্তটিকে সঠিক বলে মনে করি না। কোনো সংগঠন বা ফোরামে সবার সব পরামর্শ গৃহীত হবে এমনটি বাস্তবসম্মত নয়। এরপরও এটি তার অধিকার। আমি তার সব ধরনের কল্যাণ কামনা করি। অন্যদিকে সংস্কার তোলার পর জামায়াতে ইসলামীতে অস্থিরতা বাড়ছে।
[মানবকণ্ঠ]
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.