তুরস্ক-রাশিয়া উত্তেজনা এবং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি

0
961
blank
blank

এস এইচ সোহাগ:  সম্প্রতি তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তের কাছে রাশিয়ার একটি বোমারু জঙ্গিবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। রাশিয়া বলেছে তাদের বোমারু বিমানটি সিরিয়ার আকাশ সীমান্তেই ছিল, তুরস্কে প্রবেশ করেনি। রাশিয়া আরো দাবি করে যে, বিমানটি আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে অভিযানে ছিল। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তা নাকচ করে দেন। এরদোগানের মতে, সেখানে আইএসের উপস্থিতি ছিল না । এ ঘটনায় সিরিয়ার বর্তমান সঙ্কট আরো গভীর হয়েছে।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলে আসছে প্রায় চার বছরেরও বেশি ধরে। সিরিয়ায় বাশার সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তথা প্রবাসী সরকার এবং বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠনের পর থেকেই এ যুদ্ধের সূত্রপাত।
সিরিয়া যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতির গতি বদলে দিয়েছে। আরব শাসকেরা, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রয়েছে এক দিকে আর অন্য দিকে রয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার মিত্র রাশিয়া, ইরান ও চীন।  এদের সাথে অতি সম্প্রতি যোগ দিয়েছে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো। তুরস্ক ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ বিধায় বর্তমান হামলায় ন্যাটো জোটের সমর্থন থাকার কথা। আরব দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়াই একমাত্র ইরান, রাশিয়া ও চীনের বিশ্বস্ত মিত্র। হয়ত ইরান ও রাশিয়া এই মিত্রকে কিছুতেই হারাতে চায় না। এর আগে ইরান বেশ কঠোরভাবেই সিরিয়ার দিকে  অবস্থান নিয়েছিল এবং অনেকটা জোর দিয়েই বলেছিল যে, যেকোনো মূল্যে সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন ঠেকাবে। সিরিয়ার বিমান প্রতিরাব্যবস্থাকে উচ্চমাত্রার বলে ভাবা হয়। সোভিয়েত আমলে রাশিয়ার সরবরাহকৃত কিছু আধুনিক অস্ত্রসামগ্রী এবং চীনের সরবরাহকৃত বেশ কিছু অত্যাধুনিক রাডারব্যবস্থাও মোতায়েন আছে দেশটিতে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য  সীমিত আকারে সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবং বিমান হামলা ও করেছে ও। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সমগ্র আরব বিশ্ব এবং বিশেষ করে ইরানের ওপর মার্কিন কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সিরিয়া। আর তাই হয়তো আমেরিকা চাচ্ছে সবার আগে সিরিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। কিন্তু আমেরিকার জনগণ সিরিয়া আক্রমণ সমর্থন করেন বলে মনে হয় না। তারা মনে করেন আমেরিকা ইরাক যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধে জড়ানো ঠিক হবে না। ছুতানাতা ধরে সিরিয়া আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে না। বিশ্ববিবেককে উপেক্ষা করে ওবামার যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া আক্রমণ করলে একদিন তাকে এর মাশুল দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদী মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে; যা ওবামা প্রশাসনের জন্য শুভ হবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আবার সক্রিয় হতে পারে। তুরস্কের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিপক্ষে সামরিক হামলায় অংশ নিতে পারে, যা বিশ্বশান্তির জন্য হবে ভয়াবহ হুমকি।
রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে মতপার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। বিশেষত ইউক্রেন ও সিরিয়ার ব্যাপারে তুরস্কের অবস্থান বরাবরই রাশিয়ার বিপরীতে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া বদ্ধপরিকর। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পক্ষে পুতিনের শক্ত অবস্থানের কথা কারো অজানা নয়। অন্য দিকে তুরস্ক বাশারের পতন চায়। ইসলামিক স্টেট (আইএস) ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়ে যে তেল তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে চোরাই বাজারে বিক্রি করছে, তা অতি সস্তায় পাচ্ছে তুরস্ক। এটি তুরস্কের জন্য খুবই লাভজনক।
সম্প্রতি তুরস্কের রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ঘটনার পরপরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তুরস্ক রাশিয়ার ‘পিঠে ছুরি মেরেছে’ বলে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এর ফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন এ উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে ।
গত সপ্তাহে সিরিয়ার আকাশসীমায় তুরস্ক রাশিয়ার বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। এ নিয়ে দুই দেশ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে। এরই মধ্যে এরদোগান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন করার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের তীব্র সমালোচনা করেন। এ ছাড়া সিরিয়ার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মধ্যপন্থী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালানোর জন্যও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার এই নীতিকে ‘আগুন নিয়ে খেলছে’ বলে অভিহিত করেন। তিনি রাশিয়াকে আগুন নিয়ে না খেলার পরামর্শ দেন। অবশ্য তিনি মস্কোর সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চান না বলেও মন্তব্য করেন। রাশিয়া এরই মধ্যে সেখানে সামরিক শক্তি ও হামলা জোরদার করার পাশাপাশি তুরস্কের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ায় অবস্থিত তুর্কি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালায় মস্কো কর্তৃপক্ষ। রাশিয়া ভ্রমণকারী তুর্কি নাগরিকদের সাথে তারা অসদাচরণ করেছে এবং ভিসা ছাড়া ভ্রমণের সুবিধা বাতিল করেছে। এরদোগান রাশিয়ার এসব পদক্ষেপকে আগুন নিয়ে খেলা বলে অভিহিত করেছেন। রাশিয়ায় রুশ কোম্পানিগুলো তুরস্ক সফরের প্যাকেজ বিক্রি বাতিল করে দিয়েছে। তা ছাড়া সব রুশ নাগরিককে তুরস্ক ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে এবং রাশিয়া যৌথ প্রকল্পগুলো বাতিল করেছে।
বিমান ভূপাতিতের ঘটনার পর রাশিয়া ও তুরস্ক উভয় দেশই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সঙ্ঘাতের পথ থেকে পুতিন বা এরদোগান কেউই পিছু হটছেন না। এরদোগান বলেন, বিমান ভূপাতিতের ঘটনার জন্য রাশিয়াকেই ক্ষমা চাইতে হবে, কারণ তারাই তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এরদোগান আরো বলেন, আঙ্কারায় জি-২০ সম্মেলনে তিনি পুতিনকে তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। অবশ্য এরদোগান তুর্কি বাহিনীর হাতে রুশ জঙ্গিবিমান ভূপাতিতের ঘটনাটি বেদনাদায়ক বলে স্বীকার করেছেন এবং এমনটি ঘটুক তা তিনি কামনা করেননি। তবে দুঃখ প্রকাশের আগে তিনি রাশিয়ার সমালোচনা করেন। এমনটি ঘটুক তা তিনি চাননি, অথচ তা ঘটেছে। এমনটি যেন আর না ঘটে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, উভয় পক্ষ বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা উচিত।
সিরিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তার সাক্ষ্য বহন করে।  দ্বিধাবিভক্ত বিশ্ব আজ স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। এ স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই এখন দেখার বিষয় ।

এস এইচ সোহাগ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য